Published : 26 May 2025, 07:15 PM
সীমান্ত কি ফের উত্তপ্ত বলা যাবে? হয়তো। তবে এই উত্তাপের আঁচ লাগছে এবার ধীরলয়ে। প্রভাব সুদূরপ্রসারী। বলছিলাম ভারত থেকে পুশইনের কথা। বিজিবির তথ্য অনুযায়ী, “গত ৭ মে থেকে ২৬ মে পর্যন্ত খাগড়াছড়ি সীমান্ত দিয়ে ১০৪, কুড়িগ্রামে ৪৬, সিলেটে ৩৭, মৌলভীবাজারে ৩৩১, দিনাজপুরে ২, ঠাকুরগাঁওয়ে ১৯, পঞ্চগড়ে ৩২, লালমনিরহাটে ২০, চুয়াডাঙ্গায় ১৯, ঝিনাইদহে ৪২, কুমিল্লায় ১৩, ফেনীতে ৯ জনসহ মোট ৭০৪ জনকে পুশইন করেছে ভারত। এছাড়া সুন্দরবনের গহীন অরণ্যের মান্দারবাড়িয়া এলাকায় ৭৮ জনকে পুশইন করা হয়েছে।” বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য হলো, “যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে পুশইন করায় বিএসএফের সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে মৌখিক ও লিখিতভাবে জোরালো প্রতিবাদ জানিয়েছে বিজিবি। এছাড়া পুশইন রোধে বিজিবি সীমান্তে গোয়েন্দা নজরদারি ও টহল তৎপরতা বৃদ্ধি করে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।”
একটু আন্তর্জাতিক আইনে চোখ বোলানো যাক। ‘পুশ-ইন’ বলতে বোঝায় কোনো রাষ্ট্রের সীমান্তরক্ষী বাহিনী কর্তৃক ব্যক্তি অথবা ব্যক্তিদের জোরপূর্বক প্রতিবেশী রাষ্ট্রে ঠেলে দেওয়া, যেখানে তাদের নাগরিকত্ব বা বসবাসের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় সাধারণত কোনো আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয় না এবং ব্যক্তিদের আশ্রয় প্রার্থনার সুযোগও দেওয়া হয় না। এটি আন্তর্জাতিক অভিবাসন ও মানবাধিকার আইন অনুযায়ী বিতর্কিত এবং অনেক ক্ষেত্রে অবৈধ হিসেবে বিবেচিত হয়। আন্তর্জাতিক আইনে ‘পুশ-ইন’ বা ‘পুশব্যাক’-এর কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই, তবে এটি সাধারণত ‘নন-রিফাউলমেন্ট’ বা অ-প্রত্যর্পণ নীতির লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত হয়।
১৯৫১ সালের শরণার্থী কনভেনশনের ৩৩(১) ধারা অনুযায়ী ‘নন-রিফাউলমেন্ট’ নীতি প্রযোজ্য, যার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তিকে এমন দেশে পাঠানো যাবে না যেখানে তার প্রাণ বা স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়বে। এই নীতি অন্যান্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত। পুশ-ইন প্রক্রিয়ায় ব্যক্তিদের কোনো আইনি প্রক্রিয়া ছাড়াই ফেরত পাঠানো হয়, যা আন্তর্জাতিক আইনের এই মৌলিক নীতির পরিপন্থী। বিশেষ করে, ইউরোপীয় মানবাধিকার কনভেনশনের প্রোটোকল ৪-এর ধারা ৪-অনুযায়ী ‘collective expulsion of aliens shall be prohibited’ তথা শরণার্থীদের সমষ্টিগত বহিষ্কার নিষিদ্ধ। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বহুবার দক্ষিণ এশিয়ার সীমান্তে পুশ-ইন প্রক্রিয়াকে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে অভিহিত করেছে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন এবং ব্যক্তিকে রাষ্ট্রবিহীন করে তোলার ঝুঁকি তৈরির কারণে তারা এই প্রক্রিয়ার সমালোচনা করে আসছে।
২০১৮ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছিল, “ভারতের পুশব্যাক নীতি আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে এবং এতে মানুষ রাষ্ট্রবিহীন হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে।”
পুশ-ইন কেবল মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়, এটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কেও প্রভাব ফেলে। যখন একটি রাষ্ট্র তার সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে ব্যবহার করে অন্য রাষ্ট্রে ব্যক্তিদের জোরপূর্বক ঠেলে দেয়, তখন তা ওই রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করে। এটি দুই দেশের মধ্যে আস্থার সংকট সৃষ্টি করতে পারে এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতি ঘটাতে পারে। ভারত থেকে বাংলাদেশে যে সাতশর বেশি মানুষ ঠেলে দেয়া হলো, তাদের মধ্যে বাংলাদেশি নাগরিক আছে বটে। কিন্তু তাতে রোহিঙ্গাও আছে। এমনকি একাধিক রোহিঙ্গার কাছে ভারতে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার নিবন্ধিত পরিচয়পত্র পাওয়া গেছে। সবচেয়ে শঙ্কার চিত্র হলো সুন্দরবনের মান্দারবাড়িয়ার পুশ-ইন। কারণ সেখানে নিশ্চিতভাবেই নৌ-যান ব্যবহার করে ওই ৭৮ জনকে রেখে যেতে হয়েছে। বিজিবির চোখ এড়িয়ে এই ঘটনা যথেষ্টই শঙ্কার জন্ম দেয়।
পুশ-ইনের ফলে সীমান্ত অঞ্চলে মানবিক সংকট সৃষ্টি হয়। যারা পুশ-ইনের শিকার হন, তাদের অনেকেরই বসবাসের কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা থাকে না, ফলে তারা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েন। তারা যদি বাংলাদেশি নাগরিকও হন, তবুও তাদের আইনের মুখোমুখি হতে হয়, জেলে যেতে হয়। আবার সরকারকেও তাদের পরিচয় নিশ্চিত করার বন্দোবস্ত করতে হয়। এছাড়া, এই প্রক্রিয়া সীমান্ত অঞ্চলে নিরাপত্তা হুমকি সৃষ্টি করতে পারে, যেমন মাদক পাচার বা অন্যান্য অপরাধমূলক কার্যক্রমের ঝুঁকি বাড়ে। কোনো দেশের নাগরিক অবৈধভাবে অন্য দেশে থাকলে, তাকে ফেরত পাঠানোর সুনির্দিষ্ট পন্থা আছে। এবং ওই চর্চাও আছে। ভারত একদিকে যেমন পুশ-ইন করছে আবার, আনুষ্ঠানিকভাবে দুই হাজার তিনশর বেশি বাংলাদেশিকে ফেরত নিতে চিঠি দিয়েছে। তাদের পরিচয় যাচাই বাছাই শেষে হয়তো নাগরিকদের ফিরিয়ে আনাও হবে। কিন্তু পুশ-ইন বাড়তে থাকা চলতি সম্পর্কের বাস্তবতায় শুধু অস্বস্তিই বাড়াচ্ছে।
এই পুশ-ইনের ঘটনায় ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও নির্বাচনি রাজস্বার্থও বিবেচ্য। আগামী বছর পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন। এই ধরনের সময়ে ‘অবৈধ’ বাংলাদেশিদের ‘দেশে ফেরত পাঠানো’ তাদের রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে ওঠে। আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়েও এই ইস্যু বিশেষভাবে স্পর্শকাতর। তাই স্থানীয় প্রশাসন অনেক সময় কেন্দ্রীয় ইঙ্গিত বা রাজনৈতিক আবহের মধ্যেই সীমান্তে পুশ-ইন বাড়িয়ে দেয়।
যেসব মানুষ পুশ-ইনের শিকার হচ্ছেন, তাদের অনেকেরই কাগজপত্র নেই, জাতীয় পরিচয়ও স্পষ্ট নয়। এতে স্থানীয় প্রশাসনের ওপর বিপুল চাপ পড়ে। শুধু যারা আটক হচ্ছেন, তারাই পরিসংখ্যানে যুক্ত হচ্ছেন। কিন্তু বিজিবির চোখ এড়িয়ে যদি এই সংখ্যায় পুশ-ইন সম্ভব হয়, তাহলে আটক না হয়ে দেশে ঢুকে পড়াও যে সম্ভব, তা বললে বোধহয় অত্যুক্তি হবে না। এটি তো সুস্পষ্টভাব সীমান্ত নিরাপত্তার দুর্বলতার প্রকাশ। এতে মাদকপাচার, অস্ত্র চোরাচালান এমনকি জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িত কারও অনুপ্রবেশের শঙ্কাও উড়িয়ে দেয়া যায় না।
বিজিবি ও বিএসএফের মধ্যে দফায় দফায় পতাকা বৈঠক হলেও চোরাপথে বা বিজিবির অগোচরে মানুষ ঢুকিয়ে দেওয়ার ঘটনা বেড়েছে। এতে সীমান্তে উত্তেজনা বাড়ছে। ২০২৪ সালে সীমান্তে ভারতীয় গুলিতে অন্তত ৩৫ জন বাংলাদেশি নাগরিক মারা গেছেন। চলতি বছর মে পর্যন্ত মারা গেছেন অন্তত ১২ জন, যাদের মধ্যে কয়েকজন এই পুশ-ইনের শিকার বলেও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঐতিহাসিক এবং কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৫ সালের ছিটমহল বিনিময় বা সীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন ছিল দুই দেশের মৈত্রীর নিদর্শন। কিন্তু এমন পুশ-ইনের ঘটনা ওই আস্থার জায়গাটিকে আঘাত করে দেয়। গত বছরের ৫ অগাস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর থেকেই বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ভিসা বন্ধ, ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল, আমদানিতে নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদির পর পুশ-ইন বাড়বাড়ন্ত ওই টানাপোড়েনে আরেকটি পেরেক। দুই দেশেরই যে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য, ভালো সম্পর্ক চাওয়া, ন্যায্যতার সম্পর্ক তৈরি করা, তা থেকে যাচ্ছে কথার কথায়। পুশ-ইন বাড়িয়ে ঢাকাকে চাপে রাখতে চাইছে কিনা দিল্লি, ওই প্রশ্নও উঠছে।
ভারতের কিছু ইংরেজি দৈনিক যেমন দ্য টেলিগ্রাফ, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস সীমান্ত অনুপ্রবেশ ইস্যুকে ভারতের ‘ঘরের ভেতরের চাপ মোকাবিলার কৌশল’ হিসেবে দেখছে। আবার আসাম ট্রিবিউন, যুগশঙ্খর মতো স্থানীয় পত্রিকাগুলো বাংলাদেশিদের ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে আখ্যা দিচ্ছে। তারা সরকারকে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি তুলেছে। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম এই পুশ-ইনকে আন্তর্জাতিক আইন ও কূটনৈতিক চুক্তির লঙ্ঘন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সব মিলিয়ে এই পুশ-ইন কতটা ভারতের অভ্যন্তরীণ চাপ, কতটা আঞ্চলিক রাজনীতি ওই সমীকরণও গুরুত্বপূর্ণ।
এই যখন বাস্তবতা তখন করণীয় কী? কেবল সীমান্ত বৈঠক বা পতাকা বৈঠক কি যথেষ্ট? দুই বাহিনীর মহাপরিচালক, প্রয়োজনে স্বরাষ্ট্র-পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব বা মন্ত্রীপর্যায়ে আলোচনা জরুরি। পর্যালোচনা কমিটিও গঠন করা যেতে পারে। একইসঙ্গে বাড়াতে হবে সীমান্তের নিরাপত্তা। জনবলের বাইরেও প্রযুক্তি তথা, ড্রোন, সিসিটিভি, স্মার্ট সেন্সর ও মোবাইল পেট্রোলিংয়ের মাধ্যমে নজরদারি বাড়াতে হবে। সীমান্তের অরক্ষিত অংশগুলো চিহ্নিত করে সেখানে দ্রুত নিরাপত্তামূলক অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। পুশ-ইন ভিকটিমদের নিয়ে কাজ করার জন্য স্থানীয় প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও এনজিওদের মধ্যে সমন্বয় জরুরি।
সীমান্তে পুশ-ইন নতুন কোনো ঘটনা নয়, তবে এর সাম্প্রতিক প্রবণতা, ঘনত্ব এবং অনিয়ন্ত্রিত রূপ একে নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে। এটি শুধু একটি সীমান্ত ইস্যু নয়, বরং দুই দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা, নিরাপত্তা কৌশল এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার প্রতিফলনও বটে। সীমান্তে মানবাধিকার রক্ষা ও আইন বজায় রেখে কেবল দ্বিপক্ষীয় আস্থা নয়, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাও নিশ্চিত করা সম্ভব। আস্থার দেয়ালে ফাটল নয়, মৈত্রী থাকুক দুই দেশের জনগণের সম্পর্কে।