Published : 03 Jun 2025, 06:45 PM
অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে ‘বৈষম্যবিরোধী’ চেতনার বাজেটেও অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার সুযোগ রাখা যে ‘ভালো কিছু হয়নি’ তা কবুল করলেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ।
মঙ্গলবার বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, “আমরা বলছি না যে খুব ভালো জিনিস করে ফেলছি কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে।“
সোমবার ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৮৯ হাজার ৯৯৯ কোটি টাকার বাজেট উত্থাপন করেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ। সেখানে অপ্রদর্শিত অর্থ আবাসন খাতে বিনিয়োগ করে বৈধ করার সুযোগ রাখা হয়েছে। তবে সেজন্য পাঁচ গুণ বেশি কর দিতে হবে।
এর সমালোচনা করে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেছেন, “এতে বৈধ পথে উপার্জনকারীদের সঙ্গে বৈষম্য তৈরি হবে। তাছাড়া এই পদক্ষেপে সরকারের খুব বেশি আয় হবে বলে মনে হয় না।”
আর টিআইবি বলছে, “অন্তর্বর্তী সরকারের এ উদ্যোগ রাষ্ট্রীয় সংস্কার, বিশেষ করে দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কারের মূল উদ্দেশ্যের বিপরীত। এই অনৈতিক, বৈষম্যমূলক ও সংবিধান পরিপন্থি।”
রাজধানীর ওসমানী মিলনায়তনে বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েন অর্থ উপদেষ্টা।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “অনেকের একটা প্রশ্ন যে-কালো টাকা সাদা করতে দেওয়া হল কেন। কালো টাকা কিন্তু ঠিক কালো টাকা না। আমরা যেটা বলেছি যে-অপ্রদর্শিত টাকা, কোনো কারণে যদি আপনার কাছে থাকে, শুধু ফ্ল্যাটের ব্যাপারে একটা বিধান দেওয়া হয়েছে।
“দুটো দিক আছে। একটা নৈতিক দিক-কালো টাকা সাদা করা, আরেকটা হল প্র্যাক্টিক্যাল দিক- টাকা-পয়সা আমরা ট্যাক্স পাব কিনা। দুই দিকেই কালো টাকা সাদা করার বিষয়ে অবশ্যই কিছু… সেটা আমরা বিবেচনা করব।”
পাচার হওয়া কালো টাকা ফিরিয়ে আনতে পারলে আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নিতে হত না বলে মন্তব্য করেন অর্থ উপদেষ্টা।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “কালো টাকা ফিরিয়ে আনা খুব সহজ কিন্তু না। কারণ, যারা পাচার করে, তারা অত্যন্ত বুদ্ধিমান লোক। লেয়ারিং করে টাকা পাঠায়। এগুলো শনাক্ত করা হচ্ছে। ১২টা উল্লেখযোগ্য কেইস নেওয়া হয়েছে, সময় লাগবে তবু কাজ এগিয়ে যাচ্ছে।“
বিভিন্ন দেশে পাচার হওয়া টাকা ফিরিয়ে আনতে লম্বা সময় লেগেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা বলছি যে এক-আধ বছর লাগতে পারে। প্রসেস শুরু হয়েছে। কালো টাকা পেলে বাজেট সাপোর্টটা হয়ত কম লাগত। আইএমএফের কাছে যেতে হত না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা সেটা পারিনি।“
সংবাদ সম্মেলনে অর্থ উপদেষ্টার বাঁয়ে ছিলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ আব্দুর রশীদ এবং অর্থ সচিব মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার।
আর অর্থ উপদেষ্টার ডান পাশে ছিলেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর এবং এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান।
সংবাদ সম্মেলনে বাজেটের প্রসঙ্গ নিয়েও কথা বলেন সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, “আমরা যেসময় দায়িত্ব নিয়েছি, ক্ষমতা নিইনি। এবং দায়িত্বটা একটা কঠিন সময়ে, একটা চ্যালেঞ্জের মুখে নিয়েছি, দেশের একটা ক্রান্তিলগ্নে। অনেকেই বলছে, আইসিউতে ছিল দেশটা। একটা খাদের কিনারে চলে আসছিল।
“সার্বিকভাবে আমি মনে করি, ভালো-মন্দ আছে; আমি মনে করি আমরা একটা জনবান্ধব, ব্যবসায়বান্ধব বাজেট দিয়েছি। বাস্তবতা দেখতে হবে আপনাদেরকে। অনেক চাহিদা থাকে, কিন্তু আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল বাজেটটা যেন বাস্তবমুখী হয়, বাস্তবায়নযোগ্য হয়।“
হঠাৎ করে অনেক সাহসী বাজেট দেওয়া সম্ভব ছিল না মন্তব্য করে তিনি বলেন, “অনেকে বলে তোমরা তো আগের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছ। আগের ম্যাক্রো ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক…আমরা ডিপার্চার করে নিয়ে গিয়ে দারুণ বিপ্লবী একটা বাজেট দিয়ে দেব, দারুণ রেভিনিউ আনব, এটা সম্ভব না।
“কিছুটা গতানুগতিক আছে, কিন্তু, একেবারে যে ইনোভেশন নেই তা না। কিছু সাহসী পদক্ষেপও আছে ট্যাক্সের ব্যাপারে। আবার কিছু-কিছু আর্থিক শৃঙ্খলাও আনতে চেষ্টা করেছি।“
বাজেটে আরও সংযোজন-বিয়োজনের সুযোগ আছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আমরা তো বাজেট দিয়েছি গতকাল, এটা ওপেন থাকবে কিছুদিন। কিছু-কিছু জিনিস আছে, সাজেশন আসবে বিভিন্ন জায়গা থেকে। আমরা চেষ্টা করব সেগুলো আমলে নিতে।“
তিনি বলেন, “বাজেটের প্রতিপাদ্য বিষয় হল দেশে সবার জীবনযাপনকে আরও স্বচ্ছ করা মানুষের জীবনযাত্রার মানোয়ন্নন করা। সেজন্য আমরা সামাজিক নিরাপত্তা খাতের ওপরও নজর দিয়েছি।
বাজেট বাস্তবায়নে সবার সহযোগিতা চেয়ে তিনি বলেন, “বাইরের প্রত্যেকটা দেশ, প্রত্যেকটা এজেন্সি বাংলাদেশ সম্পর্কে অত্যন্ত ইতিবাচক ধারণা তাদের। প্রত্যেকের ইতিবাচক মনোভাব। এই মনোভাবকে আরেকটু সুসংহত করার জন্য আমাদের ভেতরে যারা আছেন তারা যেন একটু সহযোগিতা করেন।
“কিন্তু, আমরা যদি নিজেদের বলি, খারাপ হচ্ছে, কিছুই হচ্ছে না। যাচ্ছেতাই হচ্ছে দেশ, বাইরে গিয়ে তখন আমাদের আগে সেগুলো ব্যাখ্যা করতে হয়। হ্যাঁ, ভিন্নমত থাকবে, কিন্তু দেশপ্রেম এবং দেশের মানুষের জন্য দরদ থাকলে কিছুটা সরকারকে সহযোগিতে করবেন, এটাই আমরা প্রত্যাশা করি।“