Published : 22 May 2025, 03:29 PM
মানব ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘ পূর্বপ্রাগৈতিহাসিক ভ্রমণে বের হয়েছিলেন আদি এশীয়রা। উত্তর এশিয়া থেকে দক্ষিণ আমেরিকার একেবারে দক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত ২০ হাজার কিলোমিটারেরও বেশি পথ পাড়ি দিয়েছিলেন তারা।
আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানীদের একটি দল বলছে, এ বিস্ময়কর যাত্রা হাজার হাজার বছর ধরে হয়েছিল এবং আধুনিক প্রযুক্তির আগে মানুষের দীর্ঘতম অভিবাসন ছিল এটি।
গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছে সিঙ্গাপুরের ‘নানইয়াং টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটি’ বা এনটিইউ-এর গবেষকরা। গবেষণাটি প্রকাশ পেয়েছে বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নাল ‘সায়েন্স’-এ।
গবেষণাটি ‘জিনোমএশিয়া১০০কে’ প্রকল্পের অংশ, যেখানে ১৩৯টি জাতিগোষ্ঠীর এক হাজার পাঁচশ ৩৭ জন মানুষের ডিএনএ বিশ্লেষণ করেছেন গবেষকরা। এর মাধ্যমে তারা খুঁজে বের করতে পেরেছেন আদি মানুষের অভিবাসনের বিভিন্ন পথ।
আদি এশিয়দের এই যাত্রা শুরু হয়েছিল আফ্রিকা থেকে, যেখানে মানুষের প্রথম আবির্ভাব হয়েছিল। সেখান থেকে তারা উত্তর এশিয়া হয়ে যাত্রা করে ও শেষ পর্যন্ত পৌঁছায় বর্তমান আর্জেন্টিনার তিয়েরা দেল ফুয়েগো এলাকায়।
এ অঞ্চলটি পৃথিবীতে মানব অভিবাসনের শেষ সীমান্ত বা শেষ গন্তব্য হিসেবে পরিচিত বলে প্রতিবেদনে লিখেছে বিজ্ঞানভিত্তিক সাইট নোরিজ।
গবেষকরা বলছেন, এ প্রাচীন যাত্রাপথ মোটেও সহজ ছিল না। হাজার হাজার বছর আগে পৃথিবীর ভূমির গঠন ছিল একেবারে ভিন্ন এবং কিছু কিছু অঞ্চল ছিল বরফের সেতু দিয়ে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত।
আদি মানুষের পক্ষে পায়ে হেঁটে বিশাল এই দূরত্ব পাড়ি দেওয়ার বিষয়টি সম্ভব করেছিল বরফের এসব সেতু, যা এখন পানির মাধ্যমে আলাদা হয়ে গিয়েছে। গবেষণায় উঠে এসেছে, প্রাচীন মানুষ প্রায় ১৪ হাজার বছর আগে দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর-পশ্চিমে পানামা আর কলম্বিয়া যেখানে মিলিত হয়েছে, সেখানে এসে পৌঁছেছিল।
এ প্রবেশপথ থেকে সেই আদি মানুষদের দল চারটি প্রধান পথে ভাগ হয়ে যায়। কিছু মানুষ অ্যামাজন অঞ্চলে থেকে যায়, কেউ পূর্ব দিকে শুকনো চাকো এলাকায় চলে যায় আর অন্যরা দক্ষিণে পাতাগোনিয়ার বরফাচ্ছন্ন এলাকায় যাত্রা করেছিল।
গবেষণায় আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলেছে। গবেষকরা বলছেন, এই দীর্ঘ যাত্রা প্রাচীন অভিবাসীদের জিনগত গঠনেও প্রভাব ফেলেছিল।
এনটিইউ-এর ‘এশিয়ান স্কুল অফ দ্য এনভায়রনমেন্ট’-এর অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর কিম হি লিম বলেছেন, মহাদেশ পেরিয়ে কঠিন এই যাত্রার ফলে জিনগত পার্থক্য কমে গিয়েছিল এসব আদি জনগোষ্ঠীর।
পূর্বপুরুষদের ভূখণ্ড থেকে আরও দূরে সরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের মূল জিনের ভাণ্ডারের কেবল একটি অংশই তাদের সঙ্গে ছিল। যার মানে, রোগ প্রতিরোধে সাহায্যকারী জিনের বৈচিত্র্যও কমে গিয়েছিল তাদের মধ্যে।
গবেষকরা বলছেন, এ বৈচিত্র্যের অভাব কিছু আদিবাসী সম্প্রদায়কেও বিপদে ফেলেছে। কারণ, পরে আসা ইউরোপীয় উপনিবেশকারীরা তাদের সঙ্গে নতুন রোগ নিয়ে এসেছিল।
কীভাবে এসব প্রাচীন গোষ্ঠী শত শত প্রজন্ম ধরে নতুন পরিবেশ ও আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছিল তা তুলে ধরেছেন এ গবেষণার প্রথম লেখক ও এনটিইউ-এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. এলেনা গুসারেভা।
তিনি বলেছেন, আদি এশীয়দের শরীর প্রতিটি অঞ্চলের নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে করতে বিকশিত হয়েছিল, যা তাদের অসাধারণ সহনশীলতা ও অভিযোজনক্ষমতার প্রতিফলন।
জেনেটিক গবেষণায় আরও বেশি এশীয় জনসংখ্যা অন্তর্ভুক্তের গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছেন এ গবেষণার সিনিয়র লেখক ও ‘জিনোমএশিয়া১০০কে’ প্রকল্পের বৈজ্ঞানিক পরিচালক অধ্যাপক স্টেফান শুস্টার।
তিনি বলেছেন, এশীয় জনগণের মধ্যে মানুষের জিনগত বৈচিত্র্য আগে যেমনটি ভাবা হয়েছিল তার চেয়েও বেশি মানব জিনোমের বৈচিত্র্য ধারণ করে, যা আমাদের মানব ইতিহাস ও বিবর্তনের ধারণাকে নতুনভাবে গঠন করেছে।
গবেষকরা বলছেন, এ গবেষণা কেবল প্রাচীন এশীয়দের দক্ষিণ আমেরিকায় যাত্রার চমকপ্রদ পথই দেখায়নি, বরং মানুষের অভিযোজন সক্ষমতা ও বেঁচে থাকার দক্ষতা সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে আরও গভীর করেছে।