Published : 28 May 2025, 10:35 PM
দীর্ঘ সাড়ে পাঁচ মাস বন্ধ থাকার পর শিল্প ও শ্রমিকের কথা বিবেচনায় নিয়ে মৌলভীবাজারের ফুলতলা এবং সংশ্লিষ্ট এলবিন টিলা ফাঁড়ি চা বাগান চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ চা বোর্ড।
জুড়ি উপজেলা পরিষদের সম্মেলন কক্ষে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, চা শ্রমিক প্রতিনিধি, চা বাগান কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ চা গবেষণা কেন্দ্র ও বাংলাদেশ চা বোর্ডের কর্মকর্তাদের নিয়ে মঙ্গলবার এক সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল শেখ মো. সরওয়ার হোসেন পরে বাগানে গিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলেন এবং রোববার থেকে বাগান খোলার ঘোষণা দেন। শ্রমিকরা প্রায় সাড়ে নয় মাস ধরে বেতন-রেশন পাচ্ছেন না। বাগান খোলার পর চা বোর্ডের তহবিল থেকে সোমবার শ্রমিকদের এক সপ্তাহের মজুরি দেওয়া হবে। পরে বাগান মালিক সেই টাকা পরিশোধ করে দেবেন।
মেজর জেনারেল শেখ মো. সরওয়ার হোসেন বলেন, “মালিকের উদাসীনতা, ম্যানেজমেন্টের অব্যবস্থাপনাসহ একাধিক কারণে ‘এ’ ক্লাস একটি চা বাগান অনেকদিন ধরে বন্ধ। এতে গাছেই নষ্ট হয়েছে লাখ লাখ টাকার কাঁচা চা পাতা। অন্যদিকে শ্রমিকরা আছেন মর্মান্তিক কষ্টে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বাগান চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।”
ফুলতলা ও এলবিন টিলা চা বাগান ২০২৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর থেকে পুরোদমে বন্ধ। এর আগে ১৬ সপ্তাহ (চার মাস) শ্রমিকরা কাজ করলেও বেতন পাননি। ফুলতলা চা বাগানে স্থায়ী শ্রমিক ৮৬৪ জন এবং ফুলতলার ফাঁড়ি বাগান এলবিন টিলায় ৪৩৬ জন। অস্থায়ীভাবে আছে আরও তিন থেকে ৪০০ শ্রমিক। পোষ্যসহ দুই বাগানের বাসিন্দা প্রায় ১০ হাজার।
বাগান কর্তৃপক্ষ বলছে, মালিক দীর্ঘদিন ধরে সপরিবারে লন্ডনে অবস্থান করছেন। তিনি ও তার দুই ছেলে অসুস্থ। মাঝে কিছুদনি মালিকের এক মেয়ে বাগান দেখাশোনা করেছেন। কিন্তু পরে তিনিও লন্ডনে চলে যান। এই অবস্থায় বাগানটি ‘অন্ধকারে’ নিমজ্জিত হয়।
প্রায় বছর দেড়েক আগে বিপুল পরিমাণ বকেয়া থাকার কারণে বাগানের বিদ্যুৎ সংযোগও বন্ধ করে দেয় পিডিবি। ফলে কারখানাও বন্ধ ছিল। এই অবস্থায় শ্রমিকরা খেয়ে না খেয়ে এক কঠিন ও দুর্বিসহ দিন পার করছিলেন।
সাড়ে পাঁচ মাস পর বাগান খোলার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন শ্রমিক নেতারা। বাগান চালুর জন্য সাত সদস্যের একটি কমিটিও করা হয়েছে। কমিটির প্রধান হিসেবে রয়েছেন বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক। সদস্য হিসেবে আছেন- জেলা প্রশাসনের একজন প্রতিনিধি, বাংলাদেশ চা বোর্ডের প্রকল্প উন্নয়ন ইউনিটের একজন প্রতিনিধি, শ্রম অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ চা বোর্ড সহকারী পরিচালক (বাণিজ্য), পরিসংখ্যান কর্মকর্তা ও ফুলতলা চা বাগানের ব্যবস্থাপক।
সাড়ে ৫ মাস ধরে বন্ধ ফুলতলা চা বাগান, দুর্বিষহ জীবন শ্রমিকদের
ফুলতলা চা বাগানের ব্যবস্থাপক শিহাব উদ্দিন বলেন, চা বোর্ডের সহযোগিতায় রোববার থেকেই বাগান চালু হবে।
মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মো. ইসরাইল হোসেন বলেন, “বাগান বন্ধের সময় আমি তিন-চারবার ফুলতলায় গিয়েছি। শ্রমিকদের খাবারের জন্য আমরা কিছু চালও বরাদ্দ দিয়েছি। পাশাপাশি শ্রমিক ও ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে বৈঠক করেছি। সর্বশেষ চা বোর্ডকে অনুরোধ করেছি। মঙ্গলবার আমরা একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পেরেছি। চা বোর্ড বাগানটি পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে।”
বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ইসমাইল হোসেন বলেন, “আমাদেরকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বাগানটি পরিচালনার জন্য। এরই মধ্যে আমরা কাজ শুরু করেছি। একাধিকবার বাগান পরিদর্শন করে আমরা করণীয় নির্ধারণ করছি।
“রোববার থেকে প্রুনিং শুরু হবে। প্রুনিংয়ের পর পাতা চয়ন শুরু হবে। বাগানে অনেক কাজ আছে। আর এগুলো পরিচালনার জন্য একটি পরিচালনা পর্ষদ করা হয়েছে। আশা করছি, সম্মিলিতভাবে কাজ করে বাগানটিকে পুনরায় উৎপাদনে ফিরিয়ে আনতে পারব।”
ফুলতলা বাগান পঞ্চায়েত সভাপতি রবি বুনার্জী বলেন, “চা বোর্ডের চেয়ারম্যানের প্রস্তাবে আমরা রাজী হয়েছি। আমরা চাই, বাগান চালু হোক। এর আগেও বাগান যেন বন্ধ না হয় সে জন্য ১৬ সপ্তাহ মজুরি ছাড়া কাজ করেছি। এখনো আমরা কাজ করব। তবে আমাদের অনুরোধ, পর্যায়ক্রমে যেন আমাদের বকেয়া মজুরি দিয়ে দেওয়া হয়।”
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল জানান, “আমরা ভালো সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি। চা বোর্ড দায়িত্ব নিয়েছে। এজন্য চা বোর্ডের চেয়ারম্যানকে ধন্যবাদ জানাই।”
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সহসভাপতি পংকজ কন্দ বলেন, “বাগানেকে তো শ্রমিকের চেয়ে কেউ বেশি ভালোবাসে না। এই চা বাগান সৃষ্টি শ্রমিকদের হাত ধরে। শ্রমিকরা একেকটি গাছকে তাদের একেকটি সন্তান মনে করে। ফুলতলা চা বাগানে প্রায় নয় মাস বেতন নেই। এরপরও শ্রমিকরা মাত্র এক সপ্তাহের মজুরি নিয়ে কাজ করতে রাজী হয়েছে। এতেই বুঝে নিতে হবে শ্রমিকরা বাগানবান্ধব।”