Published : 28 May 2025, 08:20 PM
ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচনে যাতে হয়, সেই প্রস্তুতি নিতে বিএনপি নেতা-কর্মীদের আহ্বান জানিয়েছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
বুধবার বিকালে রাজধানীতে আয়োজিত তারুণ্যের সমাবেশে তিনি বলেন, “নতুন প্রজন্মের প্রিয় ভাই বোনেরা, আজকের এই সমাবেশ, প্রিয় দেশবাসী আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে আপনারা জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান যাতে অনুষ্ঠিত হয়, তার প্রস্তুতি নিতে শুরু করুন।”
এর মধ্য দিয়ে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করার বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ আরেকটু বাড়াল বিএনপি।
তারেক বলেন, “আমরা ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশের জনগণের সরাসরি ভোটে জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক, জনগণের কাছে দায়বদ্ধ একটি সরকার দ্রুত দেখতে চাই।অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন হতে হবে। আবারো আমরা বলতে চাই, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।”
দলের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে তারেক বলেন, “আমি বলতে চাই, আপনারা জনগণের কাছে যান। তাদের প্রত্যাশা জানার চেষ্টা করুন, তাদের প্রত্যাশা বোঝার চেষ্টা করুন, জনগণের মন জয় করুন।কারণ জনগণই বিএনপির সকল রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস।”
এ সময় নেতা-কর্মীদের নিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শ্লোগান ধরেন–“‘দিল্লি নয় পিন্ডি নয়, নয় অন্য কোনো দেশ, সবার আগে বাংলাদেশ।’
“প্রিয় সমাবেশ বলুন, ‘প্রিয় দেশবাসী বলুন, দিল্লি নয় পিন্ডি নয়, নয় অন্য কোন দেশ, সবার আগে বাংলাদেশ’।”
বিকালে সাড়ে ৩টায় কোরআন থেকে তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে সমাবেশের কার্য্ক্রম শুরু হয়। বিকাল ৪টায় লন্ডন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সভায় যুক্ত হন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
এ সময় তুমুল করতালির মধ্যে নেতা-কর্মীরা তাদের নেতাকে অভিনন্দন জানালে হাত তু্লে তিনি শুভেচ্ছার জবাব দেন।
‘নির্বাচন নিয়ে টালবাহানা’
২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের হাল ধরা অন্তর্বর্তী সরকার দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণে রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাত সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু ভোটের সুনির্দিষ্ট তারিখ এখনো ঘোষণা করা হয়নি।
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, নির্বাচন নির্ভর করবে কতটা সংস্কার করা হল তার ওপর। প্রাথমিক সংস্কারগুলো সেরে ভোটে গেলে এ বছর ডিসেম্বরেও নির্বাচন করা যায়। আর বেশি সংস্কার করতে চাইলে নির্বাচন হতে পারে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে।
তবে সরকারের এই অবস্থানের সঙ্গে একমত নয় বিএনপি। তাদের ভাষ্য, বেশিরভাগ সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন করতে হবে নির্বাচিত সরকারের হাত দিয়ে। সেজন্য নির্বাচন দরকার, আর সেটা হতে হবে এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই।
তারেক বলেন, “আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে মনে হয় এরই ভেতরে টাল বাহানা শুরু হয়েছে বা চলছে। কথিত অল্প সংস্কার আর বেশি সংস্কারের অভিনব শর্তের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে আগামী জাতীয় নির্বাচনের ভবিষ্যৎ।”
“এরই ভিতরে জনগণ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে সংস্কার নিয়ে সময়ক্ষেপণের আড়ালে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভেতরে এবং বাইরে কারো কারো মনে হয় কিছু ভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে।”
‘আদালতকে অবমাননা করা হচ্ছে’
তারেক বলেন, “পলাতক স্বৈরাচারের সময় আমরা দেখেছি, তারা কীভাবে আদালতকে অবজ্ঞা করেছে, আদালতের রায়কে অবজ্ঞা করেছে। অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হয়, পলাতক স্বৈরাচারের পরে যেই সরকারের কাছে দেশের মানুষ আশা করেছিল যে, আইনের প্রতি সম্মান থাকবে।
“আমরা দেখেছি আদালতের রায়ের প্রতি সম্মান না দেখিয়ে যারা ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণের মেয়রের দায়িত্ব গ্রহণে বাধা সৃষ্টি করেছে, সেই স্বৈরাচারের একই ঘটনা, সেটারই পুনরাবৃত্তি আমরা দেখতে পাচ্ছি।”
দলের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “আপনাদের কাছে আমার আজকে জিজ্ঞাসা, যারা আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখায় না, যারা আদালতকে আদালতের নির্দেশকে অবজ্ঞা করে, তাদের কাছ থেকে আমরা কতটুকু সংস্কার আশা করতে পারি?
“আমি প্রায়ই একটি কথা বলি, পুঁথিগত সংস্কারের চেয়ে ব্যক্তি মানসিকতার সংস্কার অনেক বেশি জরুরি। নর্থ কোরিয়ার সংবিধানে লেখা রয়েছে ডেমোক্রেটিক পিপলস রিপাবলিক অব নর্থ কোরিয়া। সুতরাং কি লেখা আছে, তার চেয়ে বেশি যেটি জরুরি, তা হল মেনে চলা। ইশরাকের ক্ষমতা গ্রহণ বা ইশরাকের শপথ গ্রহণে বাধা সৃষ্টি করে আজ আমরা আবারো স্বৈরাচারী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাচ্ছি।”
‘রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রতিপক্ষ বানাবেন না’
তারেক বলেন, ‘নিরপেক্ষতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতাই’ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান পুঁজি।
“তাই তাদের প্রতি আমাদের আহ্বান থাকবে, তাদের প্রতি আমাদের পরামর্শ থাকবে, জনগণের বিশ্বাস ভালোবাসা নষ্ট হয়–এমন কোনো পদক্ষেপ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেওয়া ঠিক হবে না।
“একই সাথে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আবারো আহ্বান জানিয়ে বলতে চাই, গণতন্ত্রকামী জনগণ এবং গণতন্ত্রের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোকে দয়া করে প্রতিপক্ষ বানাবেন না।”
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, “যদি আপনাদের কেউ রাষ্ট্র পরিচালনায় থাকতে চায়, তাহলে সরকার থেকে পদত্যাগ করে জনগণের কাতারে আসুন, নির্বাচন করুন।
“যদি ভবিষ্যতে নির্বাচনে জনগণের রায় পান তাহলে আবার সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করুন।”
‘নতুন সাড়ে তিন কোটি ভোটার ভোটের সুযোগ চায়’
নতুন প্রজন্মের প্রায় সাড়ে তিন কোটি নাগরিক যে ভোটার তালিকায় যুক্ত হয়েছেন, সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে তারেক রহমান বলেন, “এই নতুন ভোটাররা আজ পর্যন্ত একটি জাতীয় নির্বাচনেও ভোট দিয়ে তাদের নিজের পছন্দের প্রার্থীকে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করার সুযোগ পায়নি।
“পতিত পরাজিত পলাতক স্বৈরাচারের কাছে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা কিংবা নির্বাচন কোনো গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিল না। সুতরাং সংস্কার ইস্যুর পাশাপাশি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দৃশ্যমান প্রস্তুতি নেওয়া উচিত বলে আমরা বিশ্বাস করি বা আমরা মনে করি।”
অতীতের তত্ত্বাবধায়ক সরকার তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান করলেও এবার অন্তবর্তীকালীন সরকার দশ মাসেরও সেই নির্বাচন করতে পারছে না বলে মন্তব্য করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
‘আর কথামালার রাজনীতি নয়’
তারেক বলেন, এই সময়ে মানুষের আকাঙ্ক্ষা আর স্বপ্ন দেখার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।
“আর কথামালার রাজনীতি নয়। বিএনপির আগামী দিনের রাজনীতি নিরাপদ কর্মপরিবেশ এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির রাজনীতি। এখন বাস্তবায়ন আর দৃষ্টান্ত স্থাপনের রাজনীতি।”
আগামীতে ক্ষমতায় গেলে জনসংখ্যাকে জনসম্পদের রূপান্তরে কর্মমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা, ক্ষুদ্র-কুঠির শিল্পের বিকাশ, গ্রামীণ উন্নয়নে তথ্য-প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার, ব্যাপক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনার কাজ করার পরিকল্পনা তুলে ধরেন তারেক রহমান।
দরিদ্র পরিবারের জন্য ফ্যামিলি কার্ড, প্রান্তিক কৃষক, ভূমিহীন কৃষকদের জন্য ফার্মাস কার্ড চালু, বেকারত্ব দূরীকরণে বিভিন্ন খাতভিত্তিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির খাতগুলো চিহ্নিত করা, স্কুল-কলেজে তথ্য-প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষা প্রবর্তন, ক্রীড়াকে শিক্ষা কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত করা, বিদেশি ভাষা শিক্ষা চালু করা, সরকারি ব্যবস্থাপনায় ইলেকট্রিশিয়ান, মেকানিক, ডেন্টাল হাইজিনিস্ট, মেডিকেল টেকনিশিয়ান গড়ে তুলতে কোর্স চালু করা, বিশ্বখ্যাত ই-কর্মাস প্ল্যাটফর্মের চাহিদা অনুযায়ী কর্মী গড়ে তোলা, ফ্রিল্যান্সিং আউট সোর্সিং থেকে আয় বাড়ানো, স্বাস্থ্য সেবার মান উন্নয়নে গ্রামীণ হেলথকেয়ার ওয়ার্কার গড়ে তোলা, বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া প্রভৃতি পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
তিনি বলেন, “জনগণই বিএনপির সকল রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস। আমরা সরকারে না থাকলেও একটি দায়িত্বশীল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে তরুণ প্রজন্মে সামনে দেশ এবং জনগণের উন্নয়নে বিএনপির বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে। তার কয়েকটি অগ্রধিকার কর্মসূচি আজ সংক্ষেপে আপনাদের সামনে আমি তুলে ধরলাম।
“আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি জনগণের রায় রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ পেলে দেশ এবং জনগণের উন্নয়নে পর্যায়ক্রমিকভাবে দলের গৃহীত পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করবে ইনশাআল্লাহ। তবে যে কোন দলের তাদের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হলে দরকার একটি জবাবদিহিমূলক সরকার।”
যুবদলের সভাপতি এম মোনায়েম মুন্নার সভাপতিত্বে এবং স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজীব আহসান ও ছাত্র দলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন নাছিরের যৌথ সঞ্চালনায় তারুণ্যের সমাবেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আবদুল মঈন খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহ উদ্দিন আহমদ, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি এসএম জিলানী, যুব দলের সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম নয়ন, ছাত্র দলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব বক্তব্য দেন।