Published : 28 May 2025, 07:22 PM
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি বহুল আলোচিত ও সমালোচিত ‘এক-এগারো’র সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই আইন-শৃঙ্খলার পরিস্থিতিতে অভাবনীয় উন্নতি ঘটেছিল। ওয়ান-ইলেভেনের সরকার বলে অধিক পরিচিত ওই সরকারটি দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি দপ্তরগুলোকেও রাতারাতি জনবান্ধব করে তুলতে পেরেছিল– অন্তত আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এমনটাই ছিল। রাজধানী ঢাকার অলিগলিতে দিনে-রাতে ঘুরে কখনো নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি হয়নি। বিরাজনীতিকরণের কারণে ওয়ান-ইলেভেনের কট্টর বিরোধীরাও এই সাক্ষ্য দেবেন বলে আশা করি। বিরোধীরা হয়তো বলবেন, ‘তলে তলে’ তখনও অনেক দুর্নীতি হয়েছে, সেগুলো বেশ বড় মাপের দুর্নীতি। আমি তাদের সঙ্গে তর্ক করতে যাব না, তবে আমাদের মতো আম-জনতা বেশ ভালো ছিল ওই সময়ে।
প্রায় দুই দশক পর, ২০২৫ সালের মে মাসে নতুন একটি ‘অন্তর্বর্তী সরকার’ সরকারি সেবা খাতে দপ্তরভিত্তিক শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছে। এ সময়ে ওয়ান-ইলেভেনের ওই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে, তুলনা টানা তাই অনিবার্য হয়ে ওঠে। কারণ, জনগণ তো ফলাফলই দেখতে চায়। তৎকালীন সময়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমার কয়েকটি ছোট্ট অভিজ্ঞতার কথা ভাগ করছি।
১. পাসপোর্ট অফিসের ‘মিরাকল ডে’
২০০৭ সালে আমি আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে গিয়েছিলাম পাসপোর্ট নবায়নের জন্য। দালালের দৌরাত্ম্য দেখতে হবে বলে পূর্বধারণা নিয়েই গিয়েছিলাম। কিন্তু গিয়ে দেখি, ভবনের আশপাশে কোনো দালাল নেই। ভেতরে ঢুকে আরও বিস্মিত হয়ে দেখি, ওয়ান-স্টপ সার্ভিস চালু হয়েছে। কর্মচারীদের ব্যবহারে আমূল পরিবর্তন, যা পাসপোর্ট অফিসে অতীতে কখনো দেখা যায়নি। ম্যানুয়াল পাসপোর্ট নবায়নের জন্য আবেদনপত্র, ফি জমা, বায়োডাটা যাচাই ও ডেলিভারি—সবই একতলায় সুশৃঙ্খলভাবে সম্পন্ন হয়ে গেল। স্বল্পভাষী, কিন্তু শিষ্ট কর্মচারীরা ১৫ মিনিটে প্রক্রিয়া শেষ করেন। তিন ঘণ্টার মধ্যে হাতে পেলাম নবায়নকৃত পাসপোর্ট। যে দপ্তরে দালালের ঘুষ ছাড়া ফাইল এগোত না, সেখানে মাত্র ১৮০ মিনিটে এই পরিবর্তন ছিল অ্যান্টিবায়োটিকে জীবাণু নিধনের মতো আকস্মিক।
২. রাজস্ব ভবনে দালাল-শূন্য দুপুর
ওই একই সময়ে টিআইএন নম্বরের জন্য জাতীয় রাজস্ব ভবনে যেতে হয়েছিল। কাগজপত্র জমা দেওয়ার পর মাত্র আধা ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টার মধ্যে কাজ শেষ করে ভবন ত্যাগ করি, কোনো হয়রানি ছাড়াই। কোথাও ‘ফাইল তুলি’ বা ‘স্যার একটু দেখবেন’ জাতীয় ফিসফিসানি নেই; দালালবৃত্তি একেবারে উধাও। সেদিন বুঝলাম, উচ্চপর্যায় থেকে কঠোর নির্দেশনা এলে নিম্নস্তরের সেবাদাতারা মুহূর্তেই আচরণ বদলাতে পারে।
৩. সুশৃঙ্খল ইমিগ্রেশন ও ‘ফাঁকা’ অভিজ্ঞতা
২০০৮ সালের শুরুতে উচ্চশিক্ষার্থে বেলজিয়ামে যাত্রার জন্য ঢাকা বিমানবন্দরে পৌঁছাই। দেখি, বহির্গমন ভবনে যাত্রী ছাড়া অপ্রয়োজনীয় কেউ ঢুকতে পারছে না। ইমিগ্রেশনে টিকিট ও পাসপোর্ট চেকের সময় স্টাফরা অল্প কথায় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। কোনো ঝামেলা ছাড়াই ইমিগ্রেশন পার হয়ে যাই। কিন্তু কয়েক বছর পর নতুন রাজনৈতিক শাসনকালে একই টার্মিনালে ফিরে দেখি, পুরনো ধাঁচে দালাল-কুলি-কর্মচারী মিলে ‘অভ্যর্থনার’ জন্য প্রস্তুত! দুটি দৃশ্য পাশাপাশি রাখলেই বোঝা যায়, ওপর থেকে কঠোর নির্দেশনা এলে নিচে শৃঙ্খলা কতটা বাস্তবসম্মত হতে পারে।
৪. লুটেরা বৃত্তির ‘নিমেষ’ সুপ্তি
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার পাশাপাশি আরেকটি গল্প না বললে অসম্পূর্ণ থাকবে বিষয়টি। আমার এক বন্ধু রমনা এলাকায় এক জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তার পুত্রকে প্রাইভেট পড়াত। ‘ওয়ান-ইলেভেন’ শুরু হতেই ছাত্রের মা-বাবা ‘অর্থকষ্টের’ কথা বলে টিউশন বন্ধ করে দেন। পরে বন্ধু জানায়, বড় অফিসারের পরিবার ‘অসুবিধায়’ পড়েছে, কারণ ‘উপরওয়ালা’র কড়াকড়িতে অতিরিক্ত রোজগারের পথ বন্ধ। ছাত্রের মা বলেছিলেন, “আমাদের হাত এখন টানাটানি, স্যার। পরিস্থিতি ভালো হলে আপনাকে আবার ডাকব।” এটি সিস্টেমের একটি অংশমাত্র, কিন্তু অর্থবহ ‘এক্স-রে’।
কেন আজ অতীত রোমন্থন?
কারণ, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার শিক্ষাখাত ছাড়া প্রায় সব খাতেই সংস্কার তৎপরতা শুরু করেছে। জনগণ সরকারি সব খাতের ওপর প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ। অধিকাংশ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী নিজেদের জনগণের ‘প্রভু’ মনে করতে শুরু করেন। বিগত দেড় দশকে তারা ‘জনগণের সেবক’ শব্দদ্বয়কে জাদুঘরের পথে পাঠিয়েছেন। থানা, ভূমি অফিস, বিদ্যুৎ-পানি সংযোগ, হাসপাতালের ওয়ার্ড—সর্বত্র ‘আমাকে চিনেন’ জাতীয় আচরণ আর ফাইলবাজারি। তাই দাপ্তরিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা জরুরি এখনই।
অন্তর্বর্তী সরকারের এই সংস্কার প্রচেষ্টায় আনন্দিত হওয়ার কথা, কিন্তু পারছি না। কেন? কারণ, একটি প্রশ্ন উঠছে—নতুন আইন করে, নাকি পুরনো আইনের কঠোর প্রয়োগে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব? আমি কেন দ্বিধান্বিত, তা তিনটি যুক্তিতে বিশ্লেষণ করছি।
১. আইনের প্রয়োগ বনাম আইনের প্রণয়ন
‘ওয়ান-ইলেভেন’ দেখিয়েছে, বিদ্যমান আইনেই দপ্তরগুলোকে জনবান্ধব করা সম্ভব। তখন কোনো নতুন সিভিল সার্ভিস আইন লাগেনি; লেগেছিল কঠোর মনিটরিং ও জবাবদিহি। এখন দুর্নীতি ঠেকাতে নতুন আইন বানালে প্রশ্ন ওঠে—আগের আইনেই যখন কাজ চলে, তখন অতিরিক্ত আইনি কাঠামোর প্রয়োজন কতটুকু? আইন যত জটিল, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের পথ তত প্রশস্ত। ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে তা সংস্কারের হাতিয়ার না প্রতিহিংসার অস্ত্র হবে।
২. রাজনৈতিক অপব্যবহারের ঝুঁকি
বাংলাদেশে সরকারের বলয় বদল মানেই অনেক সময় ‘লেজে-গোবরে’ বদল। অতীতে সামান্য দলীয় মিছিলেও সংবিধান-বিসর্জন, সরকারের চক্ষুশূল হয়ে প্রধান বিচারপতির ‘পদচ্যুতি’ দেখা গেছে। নতুন আইন যদি সোয়াইপ-কার্ডের মতো হয়, যাকে খুশি অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা যায়, তাহলে প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা হারানোর শঙ্কা প্রবল হয়ে ওঠে। ক্ষমতাসীনরা ‘আনুগত্য-সনদ’ না পেলে সরকারি কর্মচারীদের চাকরি খাওয়ার প্রবণতা তৈরি হতে পারে।
৩. মানবিক ও সামাজিক বিবেচনা
অধিকাংশ দপ্তরে দায়িত্ব মানে ফাইল চালানো, বেতন তোলা, সময়মতো পেনশন। বিশেষজ্ঞ দক্ষতার প্রয়োজন সীমিত, প্রশিক্ষণের সুযোগও বিরল। মধ্যবয়সী কর্মচারীদের নতুন আইটি সিস্টেম বা ‘ডিজিটাল গভর্নেন্স’ শেখার অনীহা স্পষ্ট। হঠাৎ ‘পারফরম্যান্স টার্মিনেশন’ হলে তারা কোথায় যাবেন? বাংলাদেশের শ্রমবাজারে ৪৫ বছরের পর চাকরি মেলে না; ফলে পরিবারসহ ভুগবে এক শ্রেণির মানুষ। নির্ভরশীল মা-বাবা, সন্তানদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হবে। সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হলে সংস্কারের পথ কণ্টকাকীর্ণ হতে পারে।
তাই আমি বলব, নতুন আইন না করে বিদ্যমান আইনেই কর্মশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা হোক। এজন্য কয়েকটি বিকল্প পথ নিয়ে ভাবা যায়:
· বিদ্যমান আইনের কঠোর প্রয়োগ: স্বচ্ছতার জন্য অফিসপ্রতি ‘টাইমলাইন স্লিপেজ’ পেনাল্টি চালু করা যায়। ঘুষ না দিলে ফাইল আটকে রাখলে সেই কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নির্দিষ্ট মেয়াদে সাসপেন্ড করুন।
· ই-গভর্নেন্সের বাধ্যতামূলক প্রয়োগ: পাসপোর্ট, ভ্যাট, ভূমি রেজিস্ট্রি—যেখানে ঘুষ বেশি, সেখানে অনলাইন পেমেন্ট ও সার্টিফিকেট ডেলিভারি বাধ্যতামূলক করুন। নাগরিকের ক্যাশ লেনদেন কমলে দালালের বাজার হারাবে।
· দক্ষতা উন্নয়নে বিনিয়োগ: মধ্যবয়সী কর্মচারীদের পুনঃস্কিলিংকে ‘নিরাপত্তা বলয়’ হিসেবে দেখুন। সরকারি ও বেসরকারি আইটি প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় তিন-স্তরের কোর্স তৈরি করা যায়: (ক) মৌলিক ডিজিটাল লিটারেসি, (খ) সেক্টর-নির্দিষ্ট সফট-স্কিল, (গ) জনসেবার আচরণবিধি। প্রশিক্ষণে সফলদের প্রণোদনা, ব্যর্থদের পুনঃকোর্স; ছাঁটাই শেষ হাতিয়ার হোক।
· সামাজিক সুরক্ষা পরিকল্পনা: কর্মদক্ষতায় ব্যর্থদের জন্য ‘ট্রানজিশন ফান্ড’ গড়ুন। স্বল্পসুদে ঋণ, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ, বা মৌলিক পেনশন। এতে পরিবারের শঙ্কা কমবে, সংস্কার প্রক্রিয়ার বিরোধিতা কম হবে।
· নাগরিক ফিডব্যাক মেকানিজম: হটলাইন, মোবাইল অ্যাপ ও ওয়েব পোর্টাল—ত্রিমাত্রিক ফিডব্যাক চ্যানেল রাখুন। সপ্তাহে একবার প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রধান অভিযোগগুলো প্রকাশ করুন। শাস্তি-পুরস্কারের তথ্য উন্মুক্ত রাখলে ক্ষমতার অপব্যবহার কমবে।
পরিশেষে বলব, ‘বুলডোজার’ নয়, ‘বিল্ডিং ব্লক’ চাই। ‘ওয়ান-ইলেভেন’ বিতর্কিত হলেও নাগরিক জীবনে যে সুবিধার সুগন্ধ ছড়িয়েছিল, তা অস্বীকার করা যায় না। বর্তমান সরকার যদি সত্যিই সেবামুখী প্রশাসন চায়, তবে নতুন আইন বানিয়ে বুলডোজার চালানোর বদলে বিদ্যমান আইনের কঠোর প্রয়োগে হার্ড ডিসিপ্লিন ও সফট স্কিলের সমন্বয় সম্ভব। এতে কর্মকর্তারা ভয় নয়, দায়িত্ব নেবেন; নাগরিকরা নীরবে হাততালি দেবেন, যেমন দিয়েছিলেন ২০০৭-০৮ সালে।
একুশ শতকের বাংলাদেশ স্মার্ট-টেকনোলজির ট্র্যাকে দৌড়াচ্ছে। এ যাত্রায় দরকার দক্ষ, জবাবদিহিমূলক ও মানবিক আমলা-কর্মচারী বাহিনী। তাদের দ্রুত ছাঁটাই নয়, দক্ষতায় রূপান্তরই দীর্ঘস্থায়ী সমাধান। আইন আছে, প্রযুক্তি আছে, রাজনৈতিক সদিচ্ছাও আছে—এখন দরকার নেতৃত্বের দৃঢ়তা ও পরিকল্পিত রূপায়ণ। তাহলেই হয়তো নাগরিকরা বলতে পারবেন, “হ্যাঁ, আজ অফিসে গেলাম, কাজটা এক ঘণ্টায় হয়ে গেল; পাসপোর্ট অফিসে দালাল নেই, ভাবুন একবার!”
ওই আশাতেই কলম চালালাম, যাতে কাজের পরিবেশ পাল্টানোর দায় একজন মন্ত্রী বা মহাপরিচালকের নয়, সমগ্র রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে বণ্টিত হয়। আমরা সবাই মিলে আবার একদিন আস্থার বাংলাদেশ গড়ে তুলব বলে প্রত্যাশা করি।