Published : 24 May 2025, 11:01 AM
টগড়া বাড়ির মসজিদের গেট খোলা হয়েছে অনেক আগেই। ওসি সাহেব তার দলবল নিয়ে সেখানেই আছেন। কিশোরদলের একজনের মোবাইলে ফোনে সংযোগ পাওয়ার পরও কথা বলতে না পেরে চিন্তিত আছেন। তারপর থেকে ওই নম্বরটি বারবারই বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। ডায়াল করার সাথেই সাথেই যান্ত্রিক কণ্ঠ যেভাবে বলে দিচ্ছে ‘কাঙ্ক্ষিত নম্বরটিতে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না’ তাতে মনে হচ্ছে মোবাইলটি বন্ধ হয়ে গেছে। বৃষ্টিতে ভিজে গিয়ে অথবা চার্জ শেষ হয়ে বা অন্য কোনোভাবে। আসলে কী ঘটেছে তা তারা অনুমান করতে পারে না, সেটা সম্ভবও না।
তারপর থেকেই তারা কিশোরদলের অন্য নম্বরটিতে ডায়াল করে যাচ্ছেন। কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে না। শিশির মামা বাইরে গিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন। ইমরানের মুখটা মনে হলেই তার বুকের ভেতর ঝড় বয়ে যাচ্ছে। তার সব ভাগনে-ভাগিনিদের মধ্যে ইমরান সবার বড়। ছোটবেলা থেকেই ইমরান তার খুব নেওটা। বেড়াতে আসলে বা সে ইমরানদের বাড়িতে বেড়াতে গেলে, সারাদিন গা ঘেঁষে থাকে। সব গল্প শোনায়। গতবছর ইমরানকে সুন্দরবন দেখাতে নিয়ে এসেছিল। বনরক্ষীরা দেখে ফেলায় আর বনে প্রবেশ করতে পারেনি। সেসব কথা মনে হলেই চোখ ছলছল করে উঠছে।
এসব ভাবনার ফাঁকে ফাঁকে নিজের মোবাইল ফোনের লাউড স্পিকার অন করে আদনানের কাছে থাকা নম্বরে ডায়াল করে যাচ্ছেন। রাত বেড়ে চলেছে। মোবাইল স্ক্রিনের কোনায় সময় দেখায় বারোটা তেইশ। এদিকের প্রাণ প্রকৃতি তখন গভীর ঘুমে। ঈদের আনন্দময় কোলাহল থেমে গেছে। চারদিকে এখন নিস্তব্ধ নীরবতা। মন শান্ত থাকলে এমন পরিবেশ খুব উপভোগ্য হয়ে ওঠে। কিন্তু এই বৃষ্টি ভেজা স্নিগ্ধ শান্ত গভীর রাত, শিশির মামার বুকের ভেতরের হাহাকার আরও কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়।
এসব ভাবনার মাঝে হঠাৎ শিশির মামা চমকে ওঠেন, আদনানের মোবাইলে কল যায়। লাউড স্পিকারে অপর প্রান্তের মোবাইলে রিং বাজার দীর্ঘ বিপ হয়। শিশির মামা বাইরে থেকে মোবাইল নিয়ে প্রায় দৌড়ে ওসি সাহেবের কাছে আসেন। আদনান কল রিসিভ করে ‘হ্যালো’ বলতেই ওসি সাহেব কথা বলতে শুরু করেন-
হ্যালো আদনান! তোমরা সবাই ঠিক আছো?
জি আংকেল ঠিক আছি।
আচ্ছা শোনো, আমরা মাইকে তোমাদের নাম ধরে ডাকছি শুনতে পাচ্ছো কি-না জানাও।
একজন পুলিশ কনস্টেবল টগড়া মসজিদের মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। ওসি সাহেবের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই তিনি সুইচ অন করে আদনানের নাম ধরে ডাক দেন। তারপর পরপর দুইবার তিনি আদনান, ইমরান, জিসান ও মিঠুর নাম ধরে ডাক দেন। ডাক দেওয়া শেষ হতেই ওসি সাহেব আদনানকে জিজ্ঞেস করেন-
তোমরা কি মাইকের শব্দ শুনতে পেয়েছো?
না আংকেল, আমরা কেউ কিছু শুনতে পাইনি।
ওকে, এইবার আরেকটা জায়গা থেকে ডাক দিচ্ছে। শুনতে পাও কি-না বলো।
এই কথোপকথনের ফাঁকে ওসি সাহেব নিজের মোবাইল দিয়ে ডিউটি অফিসার হাবিব সাহেবকে ফোনে সংযুক্ত করে আগেই লাইনে নিয়ে রেখেছিলেন। হাবিব সাহেব এক হাতে মাইক্রোফোন ও অন্য হাতে মোবাইলের লাউড স্পিকার অন করে বসেছিলেন। জব্বার ডাক্তার বাড়ির সুন্দরবন জামে মসজিদে বসে থেকেও তিনি ওসি সাহেব ও আদনানের সব কথা শুনতে পান। তাই ওসি সাহেব কিছু বলার আগেই নিজের করণীয় বুঝতে পারেন এবং পূর্ব নির্দেশনা অনুযায়ী তা পালন করেন। তিনিও মাইক্রোফোনে কিশোরদলের চার সদস্যের নাম ধরে ডাক দেন। ওসি সাহেব আবার জিজ্ঞেস করেন-
এবার শুনতে পেয়েছো?
জি আংকেল, এবার আমরা শুনতে পেয়েছি। তবে অনেক দূরে থেকে মনে হয়েছে।
ওকে। আমরা আসছি। আমরা হাঁক দিলে তোমরা...
হ্যালো, হ্যালো ...
লাইন কেটে যায়।
এতক্ষণ যে কথা বলতে পেরেছে তাতেই ওসি সাহেব অনেক খুশি হন। রাতের নিস্তব্ধতা এতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে বলে ধরে নেন। এবার ওসি সাহেব কিশোরদলের অবস্থান ও দূরত্বের হিসাব-নিকাশ করতে বসেন। সুন্দরবনের ঘন গাছ গাছালির কারণে স্বাভাবিকভাবে তিন-চার কিলোমিটার দূর থেকে শব্দ শোনা যায়। রাতের নীরবতার কারণে শব্দ আরও অনেক দূরবর্তী জায়গা থেকে শোনা যায়। সেক্ষেত্রে চার-পাঁচ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত শব্দ শোনা যেতে পারে। ওসি সাহেব সেভাবেই প্রস্তুতি নেন এবং কিশোরদের আনুমানিক একটা অবস্থান নির্ণয় করেন।
সুন্দরবনে প্রবেশ করতে হলে দুটি দলকেই ভোলা নদী পাড়ি দিতে হবে। সেজন্য হাবিব সাহবেকে তার দল নিয়ে উজান দিকে রসুলপুর বাজারে আসতে বলা হয়। ওসি সাহেবও নিজের দলবলসহ শরণখোলা নৌপুলিশ থানায় এসে গাড়ি ছেড়ে দেন। থানা থেকে নিজের ও হাবিব সাহেবের দলের জন্য তিনটা স্পিডবোট নিয়ে নদীপথে রসুলপুর বাজারে আসেন। তারপর দুই টিম একসাথে ভোলা নদী পাড়ি দিয়ে দার্সাভরণী পয়েন্ট দিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করেন। অপরদিক থেকে আন্দারমানিক ইকো ট্যুরিজম কেন্দ্রে অবস্থান করা নৌপুলিশ টিমকে সেলা নদী ধরে একটু পিছিয়ে নিচের দিকে এসে আরওয়াবের খাল দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে বলা হয়।
নৌপুলিশের দলনেতা ফিরোজ সাহেব সেভাবেই স্পিডবোট নিয়ে এগিয়ে যান। কিন্তু খালের শেষ প্রান্তে আসতেই আবারও বৃষ্টি শুরু হয়। তবে এসব প্রতিবন্ধকতায় তারা এখন আর দমে যাবার পাত্র নন। দুদিক থেকে দুটি দল কিশোরদলের আনুমানিক অবস্থান ধরে এগিয়ে যেতে থাকে। কিশোরদলের অবস্থা চিন্তা করে নিজেদের কষ্ট ও দুর্দশার কথা তারা ভুলে যায়। এতটুকু বয়সের চারটা ছেলে সারাদিনে তেমন কিছু না খেয়ে আছে। হাঁটার ক্লান্তি, বৃষ্টির ঠান্ডা, হিংস্র জীব-জানোয়ারের ভয়, নিশ্চয় ওদের কাবু করে ফেলেছে!
নেতিয়ে পড়া গাছ যেমন পানি পেলে সজীব হয়ে ওঠে, তেমনি মাইকের শব্দ শুনতে পেয়ে এবং মোবাইল ফোনে কথা বলতে পেরে কিশোররা সতেজ হয়ে ওঠে। তাদের শীতল দেহে তাপ আসে, নিস্তেজ প্রাণে তেজ আসে। শরীরে শক্তি আর মনে সাহস সঞ্চার হয়। লোকালয় থেকে তারা খুব বেশি দূরে নয়। মাইকের শব্দ তারা শুনতে পেয়েছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের উদ্ধার করে নিয়ে যেতে আসবে পুলিশের দল। এসব ভাবনা ও বাস্তবতা তাদের আনন্দিত করে, আন্দোলিত করে। দেহ মনে খুশির দোলা লাগে।
গাছ থেকে নিচে নামতে পারলে এক চোট নেচে নেওয়া যেত বলে ভাবে ইমরান। কিন্তু বাঘটার ভয়ে তারা গাছ থেকে নামতে পারে না। বৃষ্টির পানিতে এখন সব গাছই পিচ্ছিল হয়ে আছে, নামলে আবার চড়তে কষ্ট হবে। তাই তারা গাছে বসেই আনন্দে হই-হুল্লোড় শুরু করে। কিন্তু কিশোরদলের সে আনন্দ-হইচই, গাছের ডালে শুয়ে থাকা সাপটার পছন্দ হয় না। অনেকক্ষণ চুপচাপ থেকে সাপটা আবার এগিয়ে আসতে শুরু করে। সাপটাকে এগিয়ে আসতে দেখে চার কিশোর আবার ভয়ে তটস্থ হয়ে ওঠে। কিন্তু তাদেরকে অবাক করে দিয়ে এসময় একটি অভূতপূর্ব ঘটনা রচিত হয় এবং হতে থাকে।
কোথা থেকে চুপিচুপি একটা বানর এসে সাপের মাথাটা মুঠো করে গাছের ডালের সাথে চেপে ধরে। বানরের এমন সাহসী কাজ দেখে চারবন্ধু নির্বাক হয়ে যায়। তারা একে অপরের সাথে নীরবে দৃষ্টি বিনিময় করে, কিছু বলার ভাষা খুঁজে পায় না। এখানে তাদের কিছু করার আছে কি-না তাও তারা ভেবে পায় না। তবে সাপটাও বসে থাকে না। ডাল থেকে শরীরের নিচের দিকের অংশ ছাড়িয়ে নিয়ে পুরো শরীর দিয়ে বানরটাকে পেঁচিয়ে ধরে।
এদিকে বানরটা, সাপের মাথাটা গাছের অমসৃণ ডালের সাথে ঘষতে শুরু করে। আর সাপটা শরীর মোচর দিয়ে বানরটাকে চাপ দিতে শুরু করে। সাপের চাপ সহ্য করতে না পেরে, বানরটা চিঁ চিঁ করে চেঁচিয়ে ওঠে। চার মানব সন্তানকে সাহায্যের জন্য একটি বানরের এমন বীরোচিত উদ্যোগ, কিশোরদের কাছে তখন বড়ো বেশি অদ্ভুত ও আশ্চর্যজনক হয়ে ধরা দেয়।
চলবে...