Published : 22 May 2025, 05:54 PM
রুশ সাহিত্য মানেই যেন দীর্ঘ শীতের রাত, জানালার কাচে জমে থাকা তুষার, আর কুঁড়েঘরের এক কোণে বসে থাকা নীরব পাঠক—যার হাতে ধরা এক মোটা বই, তাতে লেখা নাম: তলস্তয়। দস্তয়েভস্কি, তুর্গেনেয়েভ, চেখভ বা পুশকিনের পাশে যে নামটি সবচেয়ে উজ্জ্বল, নিঃসন্দেহে সেটি লিও তলস্তয়ের।
কিন্তু জানেন কি, রুশ সাহিত্যে এমন তলস্তয় ছিলেন একাধিক? একজন নন, তিন-তিনজন তলস্তয় নিজেদের মতো করে আলোকিত করেছেন রুশ সাহিত্যজগৎ।
তিনজনই একই পরিবারের, অভিজাত এক বংশের উত্তরসূরি। তাদের পূর্বপুরুষ ছিলেন পিয়োত্র তলস্তয়—পিয়োত্র দ্য গ্রেটের পরামর্শদাতা, এবং রাশিয়ার ইতিহাসে প্রথমদিককার কাউন্টদের একজন। তার সেই পরিবার থেকে জন্ম নেয় তিনটি ভিন্ন কণ্ঠ—তিনজন লেখক, যারা তিনটি যুগকে ছুঁয়ে গেছেন, তিনভাবে।
১. লেভ নিকালায়েভিচ তলস্তয় (১৮২৮–১৯১০)
আমরা যাঁকে ‘লিও তলস্তয়’ নামে জানি, তিনি ছিলেন বিশ্লেষণের জাদুকর। শুধু ঔপন্যাসিক নন, ছিলেন এক দার্শনিক চিন্তক, একজন আত্মসন্ধানী। তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘যুদ্ধ ও শান্তি’ (ভইনা ই মির)—নেপোলিয়নের রাশিয়া অভিযানকে ঘিরে লেখা মহাকাব্যিক কাহিনি, যেখানে ইতিহাস, ভালোবাসা, জীবনদর্শন ও মানবমন এক অপূর্ব বুননে মিশে গেছে।
‘আন্না কারেনিনা’ উপন্যাসে তিনি তুলে ধরেছেন প্রেম, পরকীয়া, বিবাহপ্রথা এবং আত্মধ্বংসের জটিল বাস্তবতা। আর ‘পুনরুত্থান’ (ভসক্রেসেনিয়ে)-এ খোঁজ করেছেন নৈতিক জাগরণের। ছোটগল্প ‘ইভান ইলিচের মৃত্যু’ বা ‘দ্য ক্রুজার সোনাটা’—সবখানেই মেলে তার গভীর মনন ও সমাজচিন্তা। লিও তলস্তয় ছিলেন এমন এক লেখক যার প্রভাব শুধু রুশ সমাজ নয়, সারা পৃথিবীর সাহিত্য ও চেতনায় ছড়িয়ে আছে।
২. আলেক্সেই কনস্তানতিনোভিচ তলস্তয় (১৮১৭–১৮৭৫)
লিও তলস্তয়ের জন্মেরও আগে জন্ম নেন আলেক্সেই—তার সেকেন্ড কাজিন, অর্থাৎ দাদার ভাইয়ের নাতি। রাজপরিবারের ঘনিষ্ঠ হলেও আলেক্সেই ছিলেন রসিক, তীক্ষ্ণধার ব্যঙ্গকার। ‘কোজমা প্রুতকোভ’ ছদ্মনামে তিনি লিখেছেন কবিতা, রম্যরচনা, এবং ব্যঙ্গাত্মক প্রবন্ধ, যা রুশ সাহিত্যে ব্যঙ্গধারার এক নতুন যুগের সূচনা করে।
তার ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘ক্রিনিয়াজ সেরেব্রেনি’ (প্রিন্স সিলভার)—ইভান দ্য টেরিবলের শাসনামলকে কেন্দ্র করে লেখা, যেখানে ইতিহাস আর কল্পনার দারুণ মিশেল ঘটে।
৩. আলেক্সেই নিকালায়েভিচ তলস্তয় (১৮৮৩–১৯৪৫)
তিন তলস্তয়ের মধ্যে সবচেয়ে বিচিত্র ও বহুমুখী স্বর তার। তিনি লেখেন বিপ্লব, বিজ্ঞান আর সমাজতন্ত্রকে ঘিরে। জন্ম হয় জার-রাশিয়ার শেষদিকে, আর পূর্ণতা পান সোভিয়েত রাশিয়ার লেখক হিসেবে। তার উপন্যাস ‘খোজদেনিয়ে পা মুকাম’ (মুকামে যাত্রা)—রুশ বুদ্ধিজীবীদের ভাঙাগড়া ও রাজনৈতিক উত্তালতা নিয়ে এক শক্তিশালী রচনা।
তিনি রুশ সাহিত্যে প্রথমদিককার সায়েন্স ফিকশন রচয়িতাদের একজন, তার ‘আয়েলিতা’ উপন্যাসে রয়েছে মঙ্গলগ্রহ অভিযানের গল্প, যেখানে প্রেম, রাজনীতি ও বিজ্ঞান মিলে এক নতুন কল্পলোক গড়ে তোলে। আর ‘জালাতোই ক্লুচিক’ (স্বর্ণচাবি)—ছোটদের জন্য লেখা এক রূপকথা, যেখানে বিখ্যাত ‘পিনোকিও’ চরিত্রটি পায় রুশ সংস্করণের প্রাণ।
বিদেশে কাটানো সময়ের পর ১৯২৩ সালে তিনি রাশিয়ায় ফিরে এসে হয়ে ওঠেন সোভিয়েত রাষ্ট্রের সাহিত্যিক কণ্ঠস্বর—একইসঙ্গে লেখক, সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি ও প্রভাবশালী ব্যক্তি।