Published : 27 May 2025, 12:42 AM
প্রকৃতি ও শান্তির অপূর্ব মিলনস্থল ‘এগুইবং পিস ইকোপার্ক’। কর্মব্যস্ত দক্ষিণ কোরিয়ায় শহরের কোলাহল, যান্ত্রিক জীবনের চাপ ও ক্লান্তির মাঝে একফোঁটা প্রশান্তি খুঁজে পাওয়াই যেন এখানকার মানুষের বড় আকাঙ্ক্ষা। আধুনিক সভ্যতার বিস্তারের মধ্যেও কিছু কিছু স্থান আজও প্রকৃতির নিসর্গ, পরিবেশের ভারসাম্য এবং মানুষের আত্মিক প্রশান্তিকে ধরে রেখেছে। দক্ষিণ কোরিয়ার এমনই এক স্থানের নাম ‘এগুইবং পিস ইকোপার্ক’।
এটি এমন এক প্রাকৃতিক উদ্যান যা প্রকৃতি, পরিবেশ, ইতিহাস ও দুই কোরিয়ার শান্তির বার্তা বহন করে চলেছে নিঃশব্দে। এ ইকোপার্ক অবস্থিত দক্ষিণ কোরিয়ার কিয়ংগি-দো প্রদেশের গিম্পো শহরের সীমান্তবর্তী ওলগট গ্রামে, উত্তর কোরিয়ার সীমান্ত থেকে মাত্র ১ দশমিক ৪ কিলোমিটার দূরে। রাজধানী সিউল থেকে গাড়িতে প্রায় ৩ ঘণ্টার পথ। চাইলে ট্রেন ও বাসযোগেও এখানে পৌঁছানো যায়।
পার্কে পৌঁছানোর পথটিতেও যেন একধরনের ভ্রমণের অনুভূতি আসে। প্রথমেই সিউল থেকে গিম্পো শহরে বাসে যেতে হান নদীর অপরূপ সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করবে। সেই সাথে রাস্তার দুই পাশে সবুজ বন, পাহাড় আর মাঝে মাঝে দেখা মেলে মাঠ ও ফসলের ক্ষেতে গ্রামের সরলতা।
‘এগুইবং’ শব্দটির অর্থ শিশুর কাঁধ বা শিশুর ঘাড়, যার নামকরণ এসেছে পার্কটির একটি পাহাড়চূড়ার আকৃতি থেকে, যা শিশু কাঁধের মতো দেখতে। এগুইবং শৃঙ্গ হল ১৫৪ মিটার উঁচু, এটি দুই কোরিয়ার সীমান্তবর্তী জেওগাং নদীর পাদদেশে অবস্থিত।
এ শৃঙ্গ স্থাপনের পেছনে একটি লোককাহিনিও প্রচলিত রয়েছে। কাহিনিটি হলো- যখন কোরিয়ায় দ্বিতীয় মাঞ্চু আক্রমণ শুরু করে, ঠিক ওই সময় একদিন পিয়ংগানের শাসক ও তার প্রেমিকা 'এগি' জেওগাং নদীর অববাহিকায় ঘুরতে যান। ঠিক তখনই শত্রুপক্ষ তাদের তাড়া করে এবং একপর্যায়ে শাসককে শত্রুরা ধরে উত্তরে নিয়ে যায়।
পরবর্তীতে এগি নিরুপায় হয়ে একাই নদীর দক্ষিণ পাড়ে চলে আসেন। তারপর থেকে, এগি প্রতিদিন সুকগাটমেওরি পর্বতের শৃঙ্গে শাসকের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। তবে তিনি আর কখনো তার প্রেমিকের দেখা পাননি। কয়েক বছর পর এগি অসুস্থতার কারণে মারা যান এবং তার আগেই, তিনি এই শৃঙ্গে দাঁড়িয়ে নিজেকে কবর দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন, যাতে কখনো তার প্রেমিক এই স্থানে ফিরে এলে তিনি অনুভব করতে পারেন।
১৯৬৬ সালে যখন দেশটির প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি পার্ক চুং-হি এই স্থানে তার সফরকালে এই গল্পটি শুনেছিলেন, তখন তিনি বলেছিলেন, "এগির গভীর দুঃখ ঠিক সেই ১ কোটি বিচ্ছিন্ন কোরিয়ান পরিবারের মতো, যারা একে অপরের সাথে নদীর স্রোতে দেখা করতে পারে না।" অর্থাৎ তিনি দুই কোরিয়ার মধ্যকার থাকা পারিবারিক বন্ধনের ফাটলের ইঙ্গিত করেছেন, যারা কোরিয়া বিভক্তির পর আর কখনো দেখা করতে পারেনি। তখন তিনি এগির স্মৃতি রক্ষার্থে নিজ হাতে এই স্থানটির নাম লিখেন 'এগুইবং পিক' এবং একটি পাথরের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করতে বলেন।
এগুইবং পিস ইকোপার্কে প্রকৃতি যেন তার রূপের সবটুকু উজাড় করে দিয়েছে। এখানে রয়েছে সুবিশাল ঘাসের মাঠ, বনভূমি, পাহাড়ি ট্রেইল, নদী এবং ছোট ছোট জলাধার। পার্ক জুড়ে গড়ে উঠেছে নানা প্রজাতির বৃক্ষ ও ফুলের সমাহার। ঋতুভেদে এখানকার প্রকৃতির রূপ বদলায়। বসন্তে চেরি ফুলের বাহারে ছেয়ে যায় পুরো পার্ক, গ্রীষ্মে সবুজের ছায়ায় শান্তির অনুভব, শরতে পাতা বদলের রঙিন সৌন্দর্য, আর শীতে বরফে ঢাকা নিঃসঙ্গ নিস্তব্ধতা। প্রতিটি ঋতুই আলাদা অভিজ্ঞতা এনে দেয় এই পার্কের প্রকৃতি জুড়ে, যা দক্ষিণ কোরিয়ায় কোনো দর্শনার্থীর জন্য একসাথে পাওয়া সত্যিই সৌভাগ্যের।
এগুইবং ইকোপার্কে রয়েছে শিশুদের জন্য আলাদা খেলার জায়গা, তথ্যকেন্দ্র, ওয়াকিং ও হাইকিং ট্রেইল, বাইসাইকেল পথ এবং পারিবারিক পিকনিকের জন্য বসার স্থান। যারা হাইকিং পছন্দ করেন, তাদের জন্য রয়েছে এগুইবং পাহাড়ে ওঠার নিরাপদ পথ। পাহাড়ের চূড়ায় উঠলে চারপাশের বনভূমি, নদী ও গ্রামের অপূর্ব দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। বুনো পাখি, প্রজাপতি, কাঠবিড়ালি থেকে শুরু করে আরও অনেক ছোট ছোট প্রাণীর দেখা মেলে সহজেই। এ যেন এক জীবন্ত প্রাকৃতিক পাঠশালা।
এই পার্কে টেলিস্কোপের লেন্সে উত্তর কোরিয়ার গ্রাম, মাঠ, আর দূরের পাহাড় দেখে অদ্ভুত এক অনুভূতি জাগে। মনে হয়, এই সীমান্তের ওপারে আরেকটি জগত, যেখানে জীবন একই সঙ্গে পরিচিত, অথচ অচেনা। পিস অ্যান্ড ইকোলজি এক্সিবিশন হলে ঢুকে কোরিয়ান যুদ্ধের ইতিহাস আর হান নদীর জীববৈচিত্র্য নিয়ে জানা যাবে এখানে। ভিডিও থিয়েটারে নদীর মোহনার গল্প মুগ্ধ করে দর্শনার্থীদের।
কোরিয়ান যুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ আর কাঁটাতারে তৈরি ‘বেল অফ পিস’ দেখে মন ভারী হয়ে ওঠবে কিছুটা। এখানে রয়েছে ক্রিসমাস টাওয়ার, যা যুদ্ধের খালি কার্তুজ দিয়ে তৈরি, যেন নীরবে শান্তির বার্তা দেয়। এছাড়া এখান থেকে হান, ইমজিন, আর ইয়েসং নদীর মোহনায় প্রকৃতির বিশালতার সৌন্দর্য উপভোগ করার মতো।
পার্কের বিশেষ দিক হলো এর পরিবেশ শিক্ষাকেন্দ্র। এখানে প্রায়ই আয়োজন করা হয় সচেতনতামূলক কর্মশালা, শিক্ষার্থীদের পরিবেশ বিষয়ক কার্যক্রম এবং শান্তিবিষয়ক প্রদর্শনী। এই পার্ক কেবল বিনোদনের জন্য নয়, বরং নতুন প্রজন্মকে প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন করার এক অন্যতম স্থান। পরিবার কিংবা একান্তে সময় কাটানোর জন্য এগুইবং পিস ইকোপার্ক হতে পারে আদর্শ স্থান। শিশুদের নিয়ে আসলে যেমন তাদের জন্য আছে খেলাধুলার সুযোগ, তেমনি প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য রয়েছে মানসিক প্রশান্তি লাভের সুযোগ। দম্পতিরা এখানে সময় কাটিয়ে ফিরে যেতে পারেন এক নতুন প্রশান্তি নিয়ে।
এগুইবং পিস ইকোপার্ক কেবল একটি ইকো-ট্যুরিস্ট স্পট নয়, বরং এটি শান্তি, প্রকৃতি ও শিক্ষা এই তিনের এক চমৎকার সমন্বয়। যারা প্রকৃতিকে ভালোবাসেন, মনকে হালকা করতে চান, কিংবা আগামী প্রজন্মকে পরিবেশবান্ধব করে গড়ে তুলতে চান, তাদের জন্য এটি এক অনন্য গন্তব্য। যান্ত্রিক জীবনের মাঝে এমন এক টুকরো শান্তির স্বর্গ সত্যিই বিরল।