Published : 29 May 2025, 12:07 AM
দ্বিতীয় পর্বের বৃষ্টিতে রাতের আঁধারে সুন্দরবনের মতো গহিন অরণ্যে অনেকক্ষণ ধরে চলতে থাকা ইংরেজি অ্যাডভেঞ্চার সিনেমার আরও একটি রোমাঞ্চকর দৃশ্য শুরু হয়। তারা উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করে। সামনে কী ঘটতে চলেছে সেটা দেখার অস্থিরতা নিয়ে অপেক্ষা করে।
কিন্তু এরই মধ্যে তারা নিজেদের অজান্তেই, বানরটার পক্ষ নিয়ে তার জয় কামনা করতে থাকে। বানরটা কী সাপটাকে মারতে পারবে! নাকি সাপের শরীরের চাপে বানরটা নিশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যাবে! নিচের বাঘটা কী আশপাশেই কোথাও আছে! বানরের চিৎকার শুনে বাঘটা যদি আবার চলে আসে! বাঘটা চলে আসলো কিনা দেখার জন্য এদিক সেদিক তাকায় কেউ কেউ।
কিশোরদের এসব ভাবনার কেন্দ্রে তখন গভীর অরণ্যের প্রাণ-প্রকৃতির মাঝে, অতিপ্রাকৃতিক বা সিনেমাটিক এক ঘটনার বাস্তবিক দৃশ্যায়ন চলতে থাকে। অপরদিকে, পৃথিবীর অন্যতম দুর্ভেদ্য ও ভয়ংকর বনরাজিতে তাদেরকে উদ্ধার করতে এগিয়ে চলেছে পুলিশের দুটি দল। পায়ে গামবুট ও গায়ে রেইনকোট থাকলেও, সম্পূর্ণ লোড করা বন্দুক কাঁধে নিয়ে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে হাঁটা সহজ নয়। কেওড়ার শ্বাসমূল ছাড়াও বিভিন্ন লতাগুল্ম ও কাঁটাযুক্ত গাছের ঝোপঝাড় মাড়িয়ে হাঁটতে হয়। গভীর রাতের অন্ধকারের সাথে তাল মিলিয়ে শুরু হয়েছে ঘন বৃষ্টি।
পিচ্ছিল পথে এ এক কণ্টকাকীর্ণ যাত্রা। কিন্তু দায়িত্ব ও কিশোরদলের উদ্ধার চিন্তা পুলিশের দুটি দলকে এই পথ পাড়ি দিয়ে এগিয়ে যেতে অনুপ্রেরণা জোগায়, উদ্যমী ও জেদী করে তোলে। তাদের এখন এই পথ চলায় কোনো ক্লান্তি নেই, হিংস্র জীব-জানোয়ারের আক্রমণের ভয় নেই। মাথায় লাগানো ওভারহেড লাইট, দুর্গম বনে রাতের অন্ধকারে তাদের পথ দেখায়। সাথে থাকা মৌয়ালরা কিছু কিছু জায়গায় দিক-নির্দেশনা ও পরামর্শ দিয়ে পথ চলতে সাহায্য করে।
বৃষ্টির পানি বাঁচিয়ে আবারও মোবাইল ফোনে কিশোরদলের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা চলে। কিন্তু বনে প্রবেশ করার পর থেকে তাদের মোবাইলের নেটওয়ার্ক সিগন্যালও দুর্বল হয়ে গেছে। এক দাগে-দুই দাগে উঠানামা করছে। তখন নিজের অভিজ্ঞতা থেকে এক মৌয়াল পরামর্শ দেন- ‘স্যার আমরা হাঁক-ডাক দিতে দিতে এগিয়ে যাই, শুনতে পেলে ওরাও নিশ্চয়ই সাড়া দিবে এবং সাহস পাবে।’
কথাটা ওসি সাহেবের খুব মনে ধরে। সেও এই কথাটাই মোবাইলে আদনানকে বলতে চেয়েছিল। শেষদিকে লাইন কেটে যাওয়ায় বলতে পারেনি। ছেলেগুলোর সাথে কথা বলে তাদেরকে যথেষ্ট বুদ্ধিমানই মনে হয়েছে তার। এতটুকু নিশ্চয়ই ওরা বুঝতে পারবে। বনের মধ্যে মৌয়ালরা এভাবেই একদল আরেক দলকে সংকেত পাঠায় এবং যোগাযোগ রক্ষা করে চলে। তাছাড়া এটি প্রাণী জগতে বহু প্রচলিত একটি পুরাতন বা প্রাচীন প্রথা। তিনি সঙ্গী মৌয়ালকেই প্রথমে হাঁক দিতে বলেন।
মৌয়াল হাঁক দেয়। তীক্ষ্ণ স্বরের সে হাঁক-ডাকের ধ্বনি, বৃষ্টি ও বাতাস কেটে আশপাশে ছড়িয়ে যায়। ঘুমন্ত বনে সে হাঁক-ডাকে কিছু পাখির ঘুম ভাঙে, তাদের কেউ কেউ পাখা ঝাপটায়। কিছু নাম না জানা প্রাণী তাদের ভাষায় প্রতিউত্তর দেয়। অল্প সময় পর মৌয়ালের হাঁক-ডাক প্রতিধ্বনি হয়ে তাদের কাছেই ফিরে আসে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত পক্ষ থেকে কোনো প্রতিউত্তর বা সাড়া আসে না। তারা ধরে নেয়, হয়তো কিশোরদল শুনতে পায়নি অথবা তারা এখনও কিশোরদের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারেনি। নতুন উদ্যম নিয়ে তারা পুনরায় এগিয়ে যেতে থাকে।
কিশোরদের পরিবারের লোকজন ও আত্মীয় স্বজনরা কাতর বাসনা নিয়ে যার যার অবস্থানে অপেক্ষারত। চোখের মণিকে কখন চোখের সামনে দেখতে পারবে! বুকের মানিককে কখন বুকে নিতে পারবে! ঝাপটে ধরে প্রাণ জুড়াতে পারবে! তারা সবাই সেই ভাবনায় বিভোর। এসব আকাঙ্ক্ষা নিয়ে সহি-সালামতে সন্তানকে ফিরে পাওয়ার জন্য কায়মনে সবাই আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছে। নফল নামাজ আদায় করে চোখের পানি ফেলছে। দোয়া দরুদ পাঠ করে সন্তানের প্রাণ ভিক্ষা চাইছে, আয়ু ভিক্ষা চাইছে।
কিশোরদলের সাথে শরণখোলা থানার ওসি সাহেবের সর্বশেষ যেসব কথা হয়েছে, ইমরানের শিশির মামার মাধ্যমে পরিবারের লোকজন তা সবই জানতে পেরেছে। ‘ছেলেরা সবাই একসাথে আছে এবং ঠিক আছে’ এটুকু জানতে পেরে তারা আল্লাহর কাছে শোকর গুজার করেছেন। ‘মাইকে ঘোষণা দিয়ে ছেলেদের আনুমানিক অবস্থান জানতে পারা, ছেলেদের জব্বার ডাক্তার বাড়ির মসজিদের শব্দ শুনতে পাওয়া, তাদের উদ্ধার করতে পুলিশের দুটি দল দুদিক থেকে সুন্দরবনে প্রবেশ করছে’ – বনে প্রবেশ করার আগে শিশির মামা সবকিছুই ইমরানের বাবাকে ফোনে জানিয়ে গেছে।
তারপর সেখান থেকে এসব খবরাখবর মিঠু, আদনান ও জিসানের পরিবারের লোকজনের কাছে ও আত্মীয় স্বজনদের কাছে পৌঁছাতে খুব বেশি সময় লাগেনি। মাইকের শব্দ শুনতে পেলে- ছেলেরা বনের কতটা গহীনে আছে, কোনদিক থেকে কতদূরে থাকতে পারে, পুলিশ কোন দিক দিয়ে গেলে কোথায় তাদের পেতে পারে, ছেলেদের কাছে পৌঁছাতে পুলিশের লোকজনের কতক্ষণ লাগতে পারে, এসব নিয়ে জেগে থাকা লোকজন বিভিন্ন রকম জল্পনা-কল্পনা করে। আর ছেলেরা এখন কেমন অবস্থায় আছে সেসব নিয়ে আশঙ্কা ও দুশ্চিন্তা করে।
বৃষ্টির পানিতে কাকভেজা কিশোররা ঠান্ডায় কাবু হয়ে গেছে। কাছাকাছি এসে গাঁ ঘেঁষে থেকে একজন আরেকজনের শারীরিক ওম নেয়। বানর আর সাপের যুদ্ধ তখনও চলমান। মাঝারি লম্বার একটি সাপকে একটি বানরের পক্ষে ভাগে আনা সহজ হয় না। বানরের চিৎকারে আশপাশের ডালে আরও কয়েকটি বানর এসে জড়ো হয়েছে। একটি বানর এসে সাপের প্যাঁচ থেকে বানরটি মুক্ত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। জড়ো হওয়া বানরেরা বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি ও শব্দ করে সাপের সাথে যুদ্ধরত বানরটিকে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছে। আর বানরটি স্বজাতির উৎসাহ পেয়ে দারুণ উদ্দীপনায় সাপের মাথাটা গাছের ডালের সাথে ঘষে যাচ্ছে।
কিন্তু সাপের প্রাণশক্তিও কম নয়। সেও সর্বশক্তি দিয়ে বিভিন্ন ঢঙে মোচড় দিয়ে বানরটির শরীরে চাপ বাড়িয়ে যাচ্ছে। বানরের চিৎকারে শুনে অনুমান করা যায়, সাপের চাপে বানরের হাড়-হাড্ডি ভেঙে যাবার উপক্রম হচ্ছে। এসব দেখে চার বন্ধু নিজেদের এক ভিন্নরকম জীবনযুদ্ধের সাক্ষী মনে করে। আর বানরটিকে ভাবতে শুরু করে বিপদে সাহায্যকারী এক পরম বন্ধু। যে বন্ধু সাপের মুখ থেকে তাদের উদ্ধার করতে নিজের জীবনকে হুমকির মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এখন তারা নিজেদের বিপদসংকুল অবস্থার কথা, বাড়ি ফেরার অনিশ্চয়তার কথা প্রায় ভুলেই গেছে।
বানরটির জন্য তাদের উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগ শুরু হয়। বানরটির ভবিতব্য নিয়ে তারা চিন্তিত হয়। সাপটি কী সাপ! তার নাম কী! পদ্ম গোখরা নাকি শঙ্খচূড় সেসব নিয়ে কথা হয়। সেসব কথায় জিসানের মনে পড়ে- সুন্দরবনে বসবাসকারী পৃথিবীর অন্যতম বিষধর সাপটির নাম শঙ্খচূড়।
এরই মধ্যে বানরের চিঁ চিঁ চিৎকার, অন্যান্য বানরের হল্লা ও বনের অন্য সকল অদেখা প্রাণীদের অচেনা শব্দের ভিড় ভেঙে মানবকণ্ঠের পরিচিত হাঁক-ডাকের মৃদু স্বর তাদের কানে বাজে। শব্দটা প্রথমে শুনতে পায় ইমরান। তারপর সে তার বাকি তিনবন্ধুকে কান পেতে শব্দটা শুনতে বলে। ভালো করে শুনে তারা নিশ্চিত হয়, এটা তাদের উদ্ধারে আসা পুলিশ সদস্যদেরই কাজ। তাদেরকে খোঁজার জন্যই হাঁক-ডাক দেওয়া হচ্ছে। বাকি করণীয় বুঝতে তাদের কোনো সমস্যা হয় না।
নিশ্চিত হতেই তাদের মধ্য থেকে আদনান প্রথমে জবাব দেওয়ার জন্য হাঁক দেয়। কিন্তু তার সারাদিনের অনাহারী কণ্ঠ থেকে যে শব্দ উচ্চারিত বা নির্গত হয়, তাকে কোনোভাবেই হাঁক বলা যায় না। এবং সে ধ্বনি কয়েক গজ দূরত্বও পায় হয় না। অন্যসময় হলে এটা নিয়ে বাকি তিনজন হাসাহাসি করতো। কিন্তু এখন সে পরিস্থিতি নেই। ইমরান মিঠুকে হাঁক দিতে বলে এবং মিঠু ক্লান্ত শরীরের অবশিষ্ট শক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করে হাঁক দেয়। ফিরে আসা প্রতিধ্বনি শুনে অনুমান করা যায় যে মিঠুর হাঁক অনেক দূর পর্যন্ত গড়িয়েছে। কিন্তু অপরপক্ষ তা শুনতে পেয়েছে কিনা তারা তা বুঝতে পারে না। তবে কোনো প্রতিউত্তর শোনা যায় না।
বানরটা অনেক জোরে তারস্বরে চিৎকার করে উঠলে, চার বন্ধু এবার সেদিকে চোখ ফেরায়। বানরটার শারীরিক কসরত দেখে বোঝা যায়, সাপটা নিজের সর্বশক্তি দিয়ে সজোরে বানরটাকে চেপে ধরেছে। গাছের বিভিন্ন ডালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অন্যান্য বানরগুলো অস্থির হয়ে তাদের মতো করে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে খেঁকিয়ে উঠছে। এদিকে সাপের চাপ বাড়ার সাথে তাল মিলিয়ে বানরটা সাপের মাথাটা দ্রুত ঘর্ষণ করছে। সে ঘর্ষণ দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে।
আদনান রিস্ক নিয়ে নিজের মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালায়। বাকি বানরগুলো হকচকিয়ে একযোগে চার বন্ধুর দিকে তাকায়। বৃষ্টির ফোঁটা পাতলা হয়ে আসছে। সেই ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির ফাঁক দিয়ে দেখা যায়- বানরটা যেখানে সাপের মাথাটা ঘষছে সেখান থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় কালচে রক্ত পড়ছে। আদনানের ফ্ল্যাশ লাইটের আলোতে আরও দেখা যায়, গাছের নিচে একটু দূরে জমাট অন্ধকার ঝোপে কেমন একটা নড়াচড়া করছে। ভয়ে আদনান দ্রুত ফ্ল্যাশ লাইট অফ করে দেয়। ভয়ে আবার সে ও অন্যরা তটস্থ হয়ে ওঠে।
চলবে...