শিল্প ও শিল্পী
Published : 22 May 2025, 12:15 AM
পাবলো পিকাসো, যার নামই পরবর্তীকালে হয়ে উঠেছিল শিল্পের এক অনন্য প্রতীক। জন্ম নিয়েছিলেন ১৮৮১ সালের ২৫ অক্টোবর, স্পেনের আন্দালুসিয়ার প্রাদেশিক রাজধানী মালাগায়। পিতা হোসে রুইজ ব্লাসকো এবং মাতা নাম মারিয়া পিকাসো গৃহে। পিতা ছিলেন একজন সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ, যিনি ‘পেপে’ নামে পরিচিত ছিলেন।
তবে তার হৃদয়ে ছিল শিল্পের প্রতি এক গভীর ভালোবাসা। তিনি মালাগা ফাইন আর্টস স্কুলে চিত্রাঙ্কনের শিক্ষক ছিলেন, পাশাপাশি শহরের আর্ট মিউজিয়ামে কিউরেটরের দায়িত্বও পালন করতেন। অবসরে নিজের আঁকা ছবি বিক্রি করতেন, শিল্পই যেন ছিল তার নিত্যদিনের সঙ্গী।
পাবলো পিকাসোর জন্মদিনটি কেবল এক নবজাতকের আগমনের দিন ছিল না, ছিল এক সৃষ্টিশীল বিপ্লবেরও সূচনা। যদিও দিনটি রুইজ পরিবারের জন্য প্রায় এক করুণ শোকবার্তায় রূপ নিতে চলেছিল। সদ্যোজাত শিশুটি নিঃশব্দ, নিথর—কোনো শ্বাস নেই, কান্নার শব্দও নয়। উপস্থিত সবাই ধরে নিয়েছিলেন, সে মৃত অবস্থায় জন্মেছে।
এই অনিশ্চয়তার মুহূর্তে আশীর্বাদ হয়ে এল এক মনুষ্য বদঅভ্যাস—অদ্ভুত হলেও তা এক অলৌকিক আনন্দ বয়ে আনল রুইজ পরিবারে।
চাচা সালভাদর, যিনি ছিলেন পেশায় একজন চিকিৎসক, তার হাতে ছিল তখন জ্বলন্ত সিগার। ভাইয়ের সন্তান নিঃসাড়, তাই তাকে মৃত্যু ভেবে টেবিলের ওপর রাখা হয়। ডাক্তার সালভাদর, তার সিগারের প্রতি একান্ত টান ভুলে না গিয়ে, সেই নিথর মুখের দিকে ঝুঁকে এলেন... এবং অবচেতন মনে ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছুড়ে দিলেন নবজাতকের মুখে।
এক মুহূর্ত, মুহূর্ত—হঠাৎ! মুখ কুঁচকে উঠল, চোখ যেন কাঁপলো, আর তারপর পৃথিবী কাঁপানো এক প্রথম কান্না! শিশুটি ফিরে এলো জীবনে—আর সে শিশুটিই হল কিংবদন্তি পাবলো পিকাসো, আধুনিক শিল্পের এক অবিস্মরণীয় নাম।
শিল্পীর জীবনীকাররা বলে থাকেন, সেই প্রথম নিঃশ্বাসের ধোঁয়া হয়তো তার স্মৃতিতে গেঁথে গিয়েছিল চিরকাল। তাই তো আমৃত্যু তিনি ধূমপান ছাড়তে পারেননি। সিগারেট, সিগার—সবই যেন হয়ে উঠেছিল তার শিল্পমগ্ন জীবনের নীরব সঙ্গী। কিন্তু এই অভ্যাস কোনো দিন তার জীবনকে সংক্ষিপ্ত করতে পারেনি; বরং তার জীবনের কঠিন সময় পেরিয়েও তিনি কাটিয়েছেন এক দীর্ঘ, উদ্ভাসিত ও সৃষ্টিশীল জীবন।
শুধু তার শিল্প নয়, পিকাসোকে ঘিরে বহু মিথ, কিংবদন্তি আর গল্পও জন্ম নিয়েছে, যার পেছনে অন্যতম অবদান তার মা মারিয়া পিকাসোর। পাবলো ছিলেন রুইজ পরিবারের প্রথম সন্তান এবং একমাত্র ছেলে। পরে মারিয়া জন্ম দেন দুই কন্যা—লোলা ও কনচিতা। কিন্তু পুত্রের প্রতি তার ভালোবাসা ছিল অগাধ, অতলান্ত। একবার বড় হয়ে ছেলেকে লেখা এক চিঠিতে মারিয়া লিখেছিলেন, “শুনেছি তুমি এখন কবিতা লিখো! তোমার পক্ষে সবই সম্ভব। যদি কেউ বলে তুমি গির্জায় ধর্মোপদেশ দিয়েছ, তাতেও আমি বিশ্বাস করব!”
শৈশবের পাবলো কেমন ছিল—তা নিয়ে মারিয়া প্রায়ই স্মৃতিচারণ করতেন। একবার বলেছিলেন, “ও ছিল অপার্থিব সুন্দর—দেবদূতের মতো পবিত্র, আবার যেন এক শয়তানের মত রহস্যময়। ওর দিকে তাকিয়ে চোখ ফেরানোই যেত না।”
অন্যদিকে, পিতা হোসে রুইজ সৌন্দর্যের প্রশংসায় না গেলেও সন্তানের শিল্পপ্রতিভায় ছিলেন মুগ্ধ। নিজে হয়তো এক সফল চিত্রশিল্পী হয়ে উঠতে পারেননি, কিন্তু পাবলোর মাঝে তিনি দেখতে পেতেন এক অপার সম্ভাবনা। তিনিই ছিলেন ছেলের প্রথম শিল্পগুরু। ১৩ বছর বয়সে এক সন্ধ্যায়, হয়তো আবেগঘন এক মুহূর্তে, পিতা তার নিজের তুলি ও রঙের প্যালেট ছেলেকে তুলে দিয়ে বলেছিলেন, “এখন থেকে এগুলো তোমার। তুমি আমাকে ছাড়িয়ে গেছ।”
পিকাসো আঁকতে শেখেন ভাষা শেখারও আগে। খেলার বয়সে যখন শিশুরা মাঠে ছোটে, তিনি বসে থাকতেন ধুলোর মাটিতে, আর নিজের কল্পনার রেখায় আঁকতেন রূপ, ছায়া, আকার—যা পরে হয়ে উঠেছে বিশ্বশিল্পের নতুন ভাষা। তার মা বলেন, ছেলেটির প্রথম উচ্চারিত শব্দ ছিল ‘পিজ’—যেটি ছিল ‘লাপিজ’ (স্প্যানিশ ভাষায় ‘পেন্সিল’) বলার অপূর্ণ চেষ্টা।
পিকাসোর শৈশব গড়ে ওঠে এক শিল্পস্নিগ্ধ পরিবেশে। পিতার তুলির টান, ক্যানভাসে রঙের খেলা আর মিউজিয়ামের নিঃশব্দ হলঘর—এসবই যেন তার হৃদয়ে বুনে দিয়েছিল সৃষ্টির বীজ। ছোট্ট পাবলো প্রায়ই তার বাবার ছবি আঁকার দৃশ্য দেখত মুগ্ধ দৃষ্টিতে। বাবা-ছেলের সেই নীরব দৃশ্যপট জুড়ে থাকত শিল্প, আলো আর রঙের নীরব ভাষা। তারা একসঙ্গে যেতেন মিউজিয়ামে, যেন শিল্পই ছিল তাদের পারিবারিক বন্ধনের এক অনন্য সেতু।
আর মা, দোনা মারিয়া ছিলেন এক স্নেহময়ী গৃহিণী। সন্তানদের প্রতি ছিল তার গভীর ভালোবাসা ও সান্নিধ্য। পিকাসো, সেই মাতৃস্নেহের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই, নিজের শিল্পী নাম হিসেবে মায়ের পারিবারিক পদবি ‘পিকাসো’ গ্রহণ করেন। তার নামের ‘এসএস’ অক্ষরজোড়া, যা স্পেনে খুব একটা দেখা যায় না, ইঙ্গিত দেয় তার পূর্বপুরুষদের জেনোয়িজ (ইতালির জেনোয়া শহর) বংশধারার।
পাবলো পিকাসোর ছিল দুই বোন—ডোলোরেস, ডাকনাম ‘লোলা’, জন্ম ১৮৮৪ সালে; এবং ছোট বোন কনসেপসিওন, যাকে সবাই আদর করে ‘কনচিতা’ বলে ডাকত, জন্ম ১৮৮৭ সালে। কনচিতা ছিল পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ এবং পিকাসোর হৃদয়ের এক স্পর্শকাতর অধ্যায়।
ছোটবেলায় পাবলো স্কুলে যেতে মোটেই পছন্দ করতেন না। পড়াশোনার ধীর গতির নিয়মে তার মন বাঁধা পড়ত না, ক্লাসরুমের একঘেয়েমি তাকে ক্লান্ত করে তুলত। শিল্পী পিকাসোর ঘনিষ্ঠ বন্ধু সাবার্তেস তার স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ ‘পিকাসো, পোর্ট্রেটস অ্যান্ড মেমোরিজ’-এ লিখেন, “ছোট্ট মালাগাবাসী পিকাসো প্রতিদিন সকালে, যখন গৃহপরিচারিকা তাকে স্কুলে নিয়ে যেত, চিৎকার করে কেঁদে উঠত।”
স্কুলের বই-পত্রে মনোযোগ না দিলেও, পাবলো অন্য এক জগতে ডুবে থাকতেন। ক্লাসে বসে কাগজ কেটে নানা আকৃতি বানাতেন, খাতার পাতায় পাতায় এঁকে যেতেন অজস্র ছবি। শিক্ষক বুঝতে পেরেছিলেন এই শিশুর মধ্যে রয়েছে অন্যরকম এক প্রতিভা, তাই তাকে অনুমতি দিয়েছিলেন ক্লাসে একটি কবুতর আনতে, আর সেই কবুতরটিই হয়ে উঠেছিল পিকাসোর বাস্তব জীবনের প্রথম মডেল। ক্লাসের এক কোণে বসে সে কবুতরটিকে বারবার এঁকে যেত—প্রতিটি রেখায় ধরা দিত তার অন্তর্দৃষ্টির প্রকাশ।
মাত্র ৮ বছর বয়সে পিকাসো আঁকলেন তার প্রথম তেলরঙের ছবি—‘দ্য লিটল ইয়েলো পিকাডোর’। এই ছবিতে এক আশ্চর্য একাগ্রতা দেখা যায়—দৃষ্টির গভীরতা, পেছনের চরিত্রদের উপস্থিতি এবং ঘোড়ায় বসে থাকা পিকাডোরের রঙিন পোশাকের খুঁটিনাটি সবই যেন এক অভূতপূর্ব শিল্পচেতনার জানান দেয়। ছবির হলুদ রঙ আর স্পষ্ট রেখার স্বতঃস্ফূর্ততা যেন বলে দেয়—একজন শিল্পীর জন্ম হয়ে গেছে।
ষাঁড়ের লড়াই—এই রক্তাক্ত কিন্তু স্পেনীয় ঐতিহ্যের দৃশ্য—পাবলোর হৃদয়ে বিশেষ জায়গা করে নেয়। পিতা পেপে প্রায়ই তাকে এসব লড়াই দেখতে নিয়ে যেতেন। রোমাঞ্চ, রক্ত, রঙ—সব মিলিয়ে পিকাসোর চেতনায় গেঁথে যেত এক অদ্ভুত আবেগ। ৯ বছর বয়স থেকেই তার আঁকার প্রধান বিষয় হয়ে ওঠে—কবুতর আর বুলফাইটের দৃশ্য।
১৮৯১ সালের শেষভাগে মালাগার জাদুঘর বন্ধ হয়ে গেলে পিকাসোর বাবা ডন হোসে রুইজ ব্লাসকোর চাকরি স্থানান্তরিত হয় স্পেনের উত্তর-পশ্চিম উপকূলের শহর কোরুনিয়াতে। নতুন জীবনের খোঁজে পুরো পরিবার পাড়ি জমায় সমুদ্রের ওই শহরে। তখন পাবলো পিকাসোর বয়স মাত্র ১০ বছর।
কোরুনিয়ায় পা রেখেই পিতার উদ্যোগে পাবলো ভর্তি হয় ‘ইনস্টিট্যুটো দে লা গারদা’ নামের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, যা শহরের ফাইন আর্টস মিউজিয়ামের সঙ্গে একই ছাদের নিচে অবস্থিত ছিল। কিন্তু পড়াশোনার প্রতি তার মন কখনোই টানেনি, বরং স্কুলের দেয়ালগুলো যেন তাকে আটকে রাখত; তার মন উড়ে যেতে চাইত ক্যানভাস আর রঙের জগতে।
১৩ বছর বয়সে পিকাসোর শৈশবজীবনে নেমে আসে এক হৃদয়বিদারক ছায়া। ছোট বোন কনচিতা ডিপথেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে যায় মাত্র ৭ বছর বয়সে। তিনি এই ঘটনার কথা প্রায় ৬০ বছর পর স্মরণ করেন তার তৎকালীন সঙ্গিনী ফ্রঁসোয়াজ জিলোর সাথে আলাপচারিতায়, যিনি এটি তার বই ‘লিভিং উইথ পিকাসো’তে লিপিবদ্ধ করেন। পিকাসো জানান, তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, যদি তার ছোট বোন সুস্থ হয়ে ওঠে, তবে তিনি চিত্রাঙ্কন ছেড়ে দেবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সে সুস্থ হয়নি, আর সেই অন্ত্যেষ্টির প্রতিশ্রুতির অদৃশ্য ছায়া শিল্পীর পুরো কর্মজীবনজুড়ে তাকে অনুসরণ করে গেছে।
তবুও শিল্প থেকে দূরে সরে থাকা সম্ভব হয়নি। ১৮৯২ সাল থেকে পাবলো কোরুনিয়া শহরের ফাইন আর্টস স্কুলে নিয়মিত ছবি আঁকার প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন। পাশাপাশি চলতে থাকে তার প্রথাগত শিক্ষা। ক্রমে তিনি রঙ, রেখা আর আলো-ছায়ার খেলায় দক্ষ হয়ে উঠতে থাকেন। প্যাস্টেল, পেন্সিলের মতো নতুন মাধ্যম তার হাতে প্রাণ পেতে থাকে। কবুতর, হাত, আর প্রিয় বোন লোলা—এই বিষয়গুলো তার ছবিতে বারবার ফিরে আসতে থাকে। লোলাই ছিল তার শৈশবের প্রথম মডেল, আর তার ভেতর দিয়েই যেন বহিঃপ্রকাশ হয়েছে এক অবিসংবিদিত শিল্প ও শিল্পীর।
পিকাসোর সৃষ্টিশীলতা কেবল ছবিতে সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি হাতে আঁকা ছোট পত্রিকা প্রকাশ করতে শুরু করেন— ‘লা কোরুনিয়া’ এবং ‘আসুল ই ব্লাঙ্কো’ নামের সেইসব ক্ষুদ্র প্রকাশনাগুলোতে ফুটে উঠত এক কিশোর প্রতিভার প্রাণস্পন্দন। সে সময়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি, মাত্র ১৩ বছর বয়সে আঁকা তার ছবি ‘দ্য বেয়ারফুট গার্ল’ এক কিশোরী কন্যার প্রতিকৃতি। এ ছবির মধ্য দিয়েই শুরু হয় ‘বসা অবস্থায় নারী’ থিমে তার চিরন্তন অন্বেষণ, যা পরবর্তী জীবনে নানা রূপে ফিরে আসে।
১৮৯৫ সালে পিকাসোর বাবা তাকে নিয়ে যান মাদ্রিদের ঐতিহাসিক প্রাদো মিউজিয়ামে, যেখানে পুরাতন শিল্পকর্মের সংস্পর্শে এসে তার মন আরও গভীরভাবে বাঁধা পড়ে শিল্পের জগতে। তবে কোরুনিয়া শহরে তাদের বসবাস দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ডন হোসে তখন বার্সেলোনার বিখ্যাত লা লঞ্জা আর্ট স্কুলে অধ্যাপক হিসেবে নতুন দায়িত্ব পান। পিকাসোর শৈশবের অধ্যায় শেষ হয়, কিন্তু সৃষ্টিশীল সেই দিনগুলোর গন্ধ যেন তার সারা জীবনজুড়ে থেকে যায়।
‘দ্য বেয়ারফুট গার্ল’ আর ‘ম্যান উইথ অ্যা ক্যাপ’—১৮৯৫ সালের শুরুতে আঁকা এই দুটি ছবি তিনি সারা জীবন নিজের সঙ্গেই রেখেছিলেন, ঠিক যেন তারা কোনো স্মৃতির জানালায় আঁকা দুটি স্থায়ী দৃশ্য। পরে এক সময় তিনি বলেছিলেন, “এই ছবিগুলোর মাঝে এখনো কোরুনিয়া শহরের গন্ধ লেগে আছে…”।