Published : 27 May 2025, 11:41 PM
ঘুঙুর তার কথা বলতে চেয়েছিল। রায়ান শুনার কোনো আগ্রহই প্রকাশ করেনি। এমনকি জানতেও চাইলো না, কী বলতে চেয়েছিল সে। শুধু তার প্রয়োজনটুকুই জানাল।
সেদিন বিকেলের ম্লান আলোয় জানালার সাথে রাখা সোফায় বসে পুরনো ম্যাগাজিনের পাতা উল্টাচ্ছিল ঘুঙুর আর মাঝে মাঝে ম্যাগাজিন থেকে চোখ সরিয়ে দূরে কোথাও তাকিয়েছিল অপলক। তখন গোধূলিবেলার সূর্যের আভা ছড়িয়ে ছিল ঘাসের উপরে, পথে পথে। অফিস শেষে কেউ কেউ বাসায় ফিরে যাচ্ছিল কংক্রিটের রাস্তা ধরে। হৈ-হুল্লোড়ে মত্ত কিছু শিশু। সেসব দৃশ্য ঘুঙুর তাকিয়ে দেখছিল আর জীবনের নানা কথা ভাবতে ভাবতে বেদনার্ত হয়ে উঠেছিল। একটা কলরবহীন বিষন্নতা চেপে বসেছিল বুকের ওপর। হঠাৎ রিঙটোন শুনে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখলো রায়ানের কল। ঘুঙুর ভেবেছিল, হয়তো তাকে মনে পড়ছিল, হয়তো আর ভুলে থাকা সম্ভব হচ্ছে না বলেই সব অভিমানকে দূরে সরিয়ে আজ এতোগুলো দিন পর ফোন করেছে। কিন্তু না, রায়ানের গলার স্বরে কোনো উদ্বেগ, কিংবা অনেকগুলো দিন কাছে না পাওয়ার, প্রিয় মানুষকে না দেখার যে অন্তর্গত আর্তি তার কিছুই সে টের পায়নি। তাই ঘুঙুর ভাবলো, তাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে, একদিক থেকে ভালোই হয়েছে। দিলে হয়তো রায়ানকে এতাদিন ধরে না দেখতে পাওয়ায় যে মানসিক যন্ত্রণা অনুভব করছিল, তা সে লুকাতে পারতো না। তবুও মনে ক্ষীণ আশা নিয়ে ভেবেছিল সেই আগের মতো রায়ান আজও পাগলামো করবে, যেমনটা বিয়ের পরপর করতো। ওর সাথে রাগ করে বাবা বাড়ি এলেই ও বারবার ফোন করে রাগ ভাঙাতে চাইতো আর ফোনে না পেলে আফিস শেষে সরাসরি বাড়ি গিয়ে বসে থাকতো ঘন্টার পর ঘন্টা। কারণে বা অকারণে স্বেচ্ছায় দোষ স্বীকার করে ঘুঙুরের রাগ ভাঙাতো। তাকে ছাড়া নিজ বাড়ি ফিরত না রায়ান, কখনোই। তাই হয়ত ঘুঙুরের ধারণা ছিল অনেক দিন পর ফোন করলেও রায়ান তার ভুল বুঝতে পেরে বলবে, সন্ধ্যায় তৈরি থেকো, অফিস শেষ করে তোমাকে নিতে আসবো। যদিও তার এই প্রত্যাশাটা অমূলক ছিল। কেননা গত কয়েক মাসে অনেক কিছুই বদলে গিয়েছে। বেশ কিছুদিন ধরে রায়ান অফিসের কাজের পর অবসর সময়টুকু সোস্যাল মিডিয়াতেই কাটায়। এই নিয়ে ঘুঙুর শুরুর দিকে কিছু না বললেও সময়ের সাথে সাথে তার বুকেও অভিমান জমতে থাকে। ধীরে ধীরে সে ভাবতে শুরু করে- হয়তো তার সাথে পথ চলতে চলতে রায়ানের ক্লান্ত লাগছে। সম্পর্কের পরতে পরতে ছড়ানো ভালোবাসা কুড়াতে কুড়াতে একঘেয়েমি এসে গেছে। কথাগুলো ভাবলেই ঘুঙুরের বুকের ভেতরটায় তোলপাড় শুরু হয়। তবুও শুরুর দিকে আত্মবিশ্বাস ছিল, মোহ কেটে গেলে কিংবা ভালো লাগা ফুরালে রায়ান ফিরে আসবে। ঘুঙুরের ভালোবাসার কাছে ধরা সে দিবেই। কিন্তু দিনের পর দিন পেরিয়ে গেলেও রায়ান তার অবস্থান থেকে বিন্দুমাত্রও সরে আসে না। রায়ানের দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা কখন যে ফুরিয়ে যেতো সে টেরও পেতো না। ম্যাসেঞ্জারে চ্যাটবক্সে কথার ঝড় বয়ে যেতো, যতক্ষণ সে চাইতো। কার সাথে কথা বলছে কিংবা কি নিয়ে এতো ব্যস্ততা তার, এসব নিয়ে প্রশ্ন করতে ঘুঙুরের ভালো লাগতো না। তাছাড়া রায়ানের বিষয়ে কেউ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করুক, এটা রায়ানেরও পছন্দ নয়। কেবল নিজের ব্যাপারেই নয়, অন্যের ব্যাপারেও প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে কাউকে বিরক্ত করে না রায়ান। তার কোনো খারাপ লাগা কিংবা ব্যক্তিগত সমস্যাও সহজে অন্যের সাথে শেয়ার করে না, খুব বেশি প্রয়োজন না হলে ঘুঙুরের সাথেও না। প্রচন্ডরকমের অন্তর্মুখী একজন মানুষ সে। তাইতো বুকে প্রশ্নের পাহাড় জমিয়েও চুপ করেই থাকতো ঘুঙুর। কোনো কারণেই সংসারে অশান্তির ঝড় নেমে আসুক, তা সে চাইতো না। তবুও ঝড় আসার প্রাক্কালে প্রকৃতিতে যেমন গাঢ় অন্ধকারের সাথে সাথে বিদ্যুৎ চমকে উঠে, রায়ান আর ঘুঙুরের সংসারেও সেরকমই থমথমে গাঢ় অন্ধকার নেমে আসতো আচমকাই। এরকমই এক ছুটির দুপুর গড়িয়ে যখন বিকেলও যায় যায় করছিল, রায়ানের অপেক্ষায় থেকে থেকে না খেয়ে টেবিলে রাখা সব খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিলো, ঠিক তখনি রায়ানের ঘরে ঢুকে নরমস্বরে ঘুঙুর জানতে চাইল, ‘তুমি খাবে না?’
প্রশ্ন শুনেই রায়ান ক্ষেপে গিয়ে উত্তর দেয়, ‘এখান থেকে যাও তো। সারাক্ষণ কানের কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর ভালো লাগে না।’
রায়ানের এমন জবাবে ঘুঙুরের আলো ঝলমলে মুখটা মুহূর্তেই যেন সন্ধ্যার আসন্ন অন্ধকারে ঢেকে গেলো। ফুরিয়ে যাওয়া দিনের বেদনার মতোই বিষাদ ছুঁয়ে গেলো তাকে। হৃদয়ভরা অভিমান নিয়ে নীরবে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় ঘুঙুর। রায়ান তা জানতেও পারেনি।
শুধু সেবারই প্রথম নয়, সোশ্যাল মিডিয়ায় জড়িয়ে যাবার পর থেকে তাদের নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় কথপোকথন ছাড়াও সংসারে প্রয়োজন এমন কিছুর কথা বললেও রায়ান বিরক্ত হতো, অকারণেই দুর্ব্যবহার করতো ঘুঙুরের সাথে।
মাসের শেষের দিকে বাজার ফুরিয়ে গেলে ভীরু ভীরু পায়ে এক সকালে রায়ানের ঘরে ঢুকে নিচুস্বরে ঘুঙুর বলেছিল, ‘শুনো না, বাসায় কিছু বাজার লাগবে, মাসের শেষ তো। অনেক কিছুই শেষ হয়ে গেছে...’
ঘুঙুরের কথা শেষ হলো কি আরও কিছু বলা বাকি আছে তা না ভেবেই রায়ান বলে উঠে, ‘বাজার নাই তো আমাকে বলতেছ ক্যান? আমি কী করবো? তোমার কাজটা কি শুনি?’ রেগে গিয়ে চোখ বড় বড় করে আরও বলে, ‘তুমি এইখানে আছটা কী করতে?’
‘ঘরের কাজও তো কম নয় রায়ান। ঘর বাহির দুই দিক সামলাইতে আমার কষ্ট হয়ে যায়।’
‘কষ্ট হয়ে যায়, না? আজাইরা প্যাঁচাল পাড়ার জায়গা পাও না? টাকা দিয়া রাখছি, নিজে গিয়া পছন্দ কইরা বাজার আনবা, সেইটাতেও কষ্ট? যাও তো এখান থেইকা যাও। বিরক্ত কইরো, না।’ ঝাঁজ দেখিয়ে বলে রায়ান।
‘আচ্ছা, যা-ই বলি তাতে তুমি বিরক্ত হও। আমি করেছিটা কী?’
‘শুনো, আমারে আমার মতো থাকতে দাও। আমার লাইফের কোনো বিষয়ে তুমি ইন্টারফেয়ার করতে আসবা না।’ মিনিটখানেক পর ডান হাতের তর্জনী উঁচু করে চোখ বড় বড় করে বলল, ‘মাইন্ড ইট।’ তখন রাগে হাত কাঁপতে থাকে তার।
রায়ানের কথা শুনে সে দ্রুতপায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় আর প্রচন্ড অভিমান বুকে নিয়ে সেই রাতেই তার বাসা ছেড়ে চলে আসে বাবার বাড়ি।
সেদিনের পর আজ প্রায় এক মাস তিন দিন পর রায়ান ফোন দিয়েছে। তাও ব্যাংকের কিছু কাগজপত্র খুঁজে না পেয়ে সেগুলো কোথায় রাখা আছে তা জানার জন্যই কেবল সে ঘুঙুরকে ফোন করেছিলো। একবারের জন্যও জানতে চাইলো না ঘুঙুর কেমন আছে? যদিও ওর এই জানতে না চাওয়াটাই তো স্বাভাবিক, ঘুঙুর অন্তত এরকমটাই ভাবে। আর কখনও তাকে যে ফিরে চাইবে না রায়ান, এটা জেনেই তো ঘুঙুর তার ছোট্ট বারান্দা, অনেকগুলো মানিপ্ল্যান্ট, শখের বাগানবিলাস, পরিচিত রান্নাঘরের প্রিয় কুকারিজের ঝনঝন শব্দ, একটু একটু করে জমানো টাকায় কেনা কফি চেয়ারের সেটটা, সবকিছু রেখে চলে এসেছিল। প্রতি সন্ধ্যায় যে চেয়ার দুটোয় বসে, দু’জনে জানালার স্বচ্ছ কাচের ওপারে তাকিয়ে থেকে আর কফির মগে চুমুক দিতে দিতে রাত্রির বুকে সন্ধ্যার হারিয়ে যাওয়াকে দেখতো, কিচিরমিচির শব্দ তুলে পাখিদের নীড়ে ফেরা দেখতো, সেই সবকিছুতে তার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে বলেই তো আজ এই আলাদা আলাদা থাকা। বেদনাকে দোসর করেই সময়গুলো কেবল অতিক্রম করে চলা। আর তাই এখনকার উজ্জ্বল সকালটাকেও কেবলি কুয়াশায় মোড়ানো চুপসে যাওয়া নীরব সকালের মতোই মনে হয় ঘুঙুরের। এই সকালের আলোতে কোনো উচ্ছলতা খুঁজে পায় না সে। দুপুরটাও কেটে যায় কেবল কাটাতে হবে বলেই। অন্তর্গত কোনো তাড়না অনুভব করে না, সময়ের হাত ধরে চলার। বিকেলের আলোতেও আগের মতো ঔজ্জ্বল্য নেই। মনে হয়, সর্বত্রই পরিবর্তনের আয়োজন। চেনা যে সময় ছিলো তা যেন বহুদূরে গেছে সরে। তবুও ফুরিয়ে যাওয়া সেসব সময়ের কিছু মায়া থেকে যায় দিনান্তে। হৃদয়ের একান্তে, নিভৃতে। পুরনো স্মৃতি আর বর্তমানের মাঝে ঘুরপাক খেতে খেতে হঠাৎ ঘুঙুর শুনতে পায়, তার কানে রিমঝিম রিমঝিম শব্দ বাজছে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে সন্ধ্যা নেমেছে এই শহরে। টাপুর টুপুর শব্দে ছন্দ তুলে অঝোরে বৃষ্টি ঝরছে। মাধবীলতা দুলছে মৃদুমন্দ হাওয়ার দোলায়। অন্ধকার জড়ানো মায়াবী এই সন্ধ্যায়, ঘরের সবগুলো বাতি নিভিয়ে বসে আছে সে জানালার পাশে। এরকমই এক মায়াবী ক্ষণে মনে পড়ে তার ফেলে আসা সেই সন্ধ্যাকে, যে সন্ধ্যার আঁধারে কেউ একজন প্রথম দু'হাত পেতে চেয়েছিল তাকে, ঠিক এমনি বৃষ্টিঝরা এক সন্ধ্যায়। সেদিনই প্রথম দেখেছিল ঘুঙুর, আঁধারের রূপ কতটা মায়াবী আর কতটা মনোহর হয়! সেদিনের সেই আঁধার রায়ানের হৃদয়েও আলো হয়ে জ্বলেছিল। ক্ষণিকের তরে সে আলো জ্বলে আবার তা ফুরিয়েও গেছে। তাইতো ঘুঙুরের স্বাভাবিক আচরণেও রায়ান বিরক্ত হতো। এইতো কয়েকদিন আগেই, রাতে ঘুঙুরের ঘুম ভেঙে গেলে দ্যাখে রায়ান পাশে নেই। বিছানা ছেড়ে একটু এগিয়ে আসতেই চোখে পড়ে ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে সে লিভিং রুমের সোফায়। ঘুমজড়ানো চোখে স্বাভাবিক ভঙিতেই ঘুঙুর তখন জানতে চাইলো, ‘তুমি এখানে কেন? এত রাতে ল্যাপটপে কি করছ?’
তার কথার জবাব এড়িয়ে গিয়ে আড়চোখে একবার ঘুঙুরের দিকে তাকিয়ে আবার ল্যাপটপের দিকে তাকায় রায়ান। পাশে গা ঘেঁষে সোফায় বসে ঘুঙুর আদুরে গলায় বলে, ‘এ্যাই, চলো না, ঘরে চলো। তুমি পাশে না থাকলে আমার ঘুম আসে না।’
‘আজাইরা আল্লাদ দেখাইতে আইসো না তো। যাও তো এখান থেইকা যাও। আমার পিছে পইড়া থাইকো না।’ বিরক্তির স্বরে তাড়িয়ে দেয়ার ভঙ্গিতে ডান হাত নেড়ে নেড়ে বলে রায়ান।
তবুও রায়ানের সেই আচরণকে উপেক্ষা করে মিষ্টি হেসে খানিকটা থেমে ঘুঙুর আবারও বলে, ‘আজাইরা না রায়ান। সত্যিই তুমি পাশে না থাকলে আমার ঘুম আসে না। বিছানাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে। চল।’
‘শুনো, তোমার এইসব ফালতু ভালোবাসায় আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।’ এই কথা বলার পরপরই আরও রেগে গিয়ে জোরালো গলায় বলে, ‘এই যা তো, এখান থেকে যা।’
মুহূর্তেই ঘুঙুরের চোখ-মুখ বিবর্ণ হয়ে যায়। বিষাদে আচ্ছন্ন হয় মন। অপমান আর তাচ্ছিল্যে দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। নিঃশব্দে ঝরতে থাকে অশ্রুফোঁটা। অথচ একটা সময় ঘুঙুরের ভালোবাসা পাবার আশায়, তাকে অন্তত একটিবার দেখার অপেক্ষায় থেকে থেকে রায়ান সারাটি দিন কাটিয়ে দিতো। সেই কিশোরিবেলায় ঘুঙুর বিকেল হলেই আনমনে দাঁড়িয়ে থাকতো ছাদের কিনারায়। বহু চেনা মুখ, সেসব বিকেলে ছাদে উঠতো। নানা রকম গল্পে মুখর হতো বিকেলের শরীর। ঘুঙুর চেয়ে থাকতো দূর আকাশের দিকে..., আনমনে, আশেপাশের সকল ভিড়, সকল কোলাহলকে ছাড়িয়ে....।
আসন্ন সন্ধ্যা যখন ধীর পায়ে পৃথিবীর বুকে নামত ঘুঙুরও নেমে আসত ছাদের বুক থেকে। হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করে, যখন সে ছাদে ফুলের টবে পানি দেয়, পাশের ছাদ থেকে বিভোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে তাকে, একটি ছেলে। ঘুঙুরের তাতে কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না। সে প্রতিদিনের মতোই পানি দেয়া শেষে ছাদ থেকে নেমে আসে। এর কিছুদিন পর লক্ষ্য করে, স্কুলে যাওয়া-আসার পথেও সেই ছেলেটি দূর হতে দাঁড়িয়ে ঘুঙুরের ফেলে আসা পথের দিকে তাকিয়ে রয়। যেন এই পথের দিকে চেয়ে থাকাতেই তার আনন্দ। উদাস দুপুর আর অবসর ক্ষণগুলোতেও তৃষ্ণার্ত নয়নে দাঁড়িয়ে থাকে জানালায়, তাও ঘুঙুরেরই অপেক্ষায়।
এতো এতো অপেক্ষা, দূর হতে এই দাঁড়িয়ে থাকা আর সারাক্ষণ অশান্ত মনকে কিছুটা শান্ত করতে আর স্থিরতা দিতেই বৃষ্টিভেজা এক সন্ধ্যায় রায়ান ছুটে যায় ঘুঙুরের কাছে। কী যেন কী ভেবে সেই সন্ধ্যায় ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিল ঘুঙুর। হয়তো বা রায়ানেরই অপেক্ষায়। যদিও সে জানতো না ছেলেটি আসবে কি না! তাছাড়া জানবে কী করে? তার সাথে তো ছেলেটির কখনো কথাই হয়নি। কেবল দৃষ্টি বিনিময়টুকু ছাড়া। ওই অতটুকুতে কী আর নিশ্চিতভাবে বলা যায়, সে আসবে? তবুও আশা আর নিরাশার দোলাচলে দুলতে দুলতে ছেলেটির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে সে। বেশ কিছুক্ষণ পর আকাশ মেঘকে আড়াল করে মৃদু হাসিতে হেসে উঠে। শীতল, মায়াময় বাতাস আলগোছে পরিপাটি বিলি কাটছিল চিরল পাতায়।
হঠাৎ ছাদের দরজা খোলার ক্যাচ ক্যাচ শব্দ হলো। কারো পায়ের শব্দও কানে এলো। তখন ঘুঙুর ছাড়া ছাদে ছিলো না অন্য আর কেউ। সে পিছনের দিকে ঘুরে তাকাতেই দেখে রায়ান তার দিকেই এগিয়ে আসছে। কাছে এসে মিষ্টি হেসে বলল, ‘আমি রায়ান। নাম নিশ্চয়ই জানো না।’
ঘুঙুর মাথা নাড়ে, মুখে কিছু বলে না।
‘কখন এসেছ তুমি?’ এমনভাবে জানতে চাইল যেন রায়ান আগে থেকেই জানতো, ঘুঙুর আজ এখানে আসবে।
‘এই তো কিছুক্ষণ আগেই।’
‘ কী ভাবছিলে? আমি কী করে জানলাম, তুমি এখানে?’ ঘুঙুরের একদম কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে তার দিকে মুখ করে তাকিয়ে থেকে জানতে চাইলো রায়ান।
ঘুঙুর নীরবে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। মৃদু হেসে রায়ান বলে, ‘তুমি যখন ছাদে উঠছিলে, আমি দেখেছিলাম।’
তখন রায়ানের উজ্জ্বল গহীন চোখ দুটি ছিলো অস্থির। ঠোঁটের উপর গাঢ় কালো তিলটায় ঘুঙুরের দৃষ্টি কিছুটা সময়ের জন্য ছিলো স্থির। তারপর ঠোঁট থেকে চোখ সরিয়ে একে অপরের দৃষ্টি ছুঁয়ে রইলো আরও কিছুক্ষণ। ততক্ষণে ঘুঙুরের হৃদয়ের বন্ধ সকল তালাগুলো যেন একে একে খুলে যাচ্ছিলো। বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছিলো কাঁপা কাঁপা নিঃশ্বাস। সরল, সহজ প্রশ্রয়ের হাসি ছড়িয়ে পড়েছিলো রায়ানের মুখ জুড়ে। তারপরই মৃদু হেসে ভ্রূজোড়া কপালে তুলে বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথেই জানতে চাইলো, ‘আমার জন্যই অপেক্ষা করছিলে, তাই না?’
হতবাক হয়ে নিষ্পলক রায়ানের দিকে তাকিয়ে থাকে ঘুঙুর। যেন নরম আলোর ঘোর নেমেছিলো তখন দু’চোখ জুড়ে। রাত্রির শেষ ভাগের স্পর্শে বিকশিত অপ্রতিরোধ্য শিউলির প্রস্ফূটিত হওয়ার মতো হৃদয়ে ভালোবাসাও প্রস্ফূটিত হচ্ছিলো, রায়ানের জন্য।
‘কী, কথা বলছো না যে, হ্যাঁ না কিছু তো বলো। হ্যাঁ অথবা না।’
চমকে উঠে এক পলক রায়ানের দিকে তাকিয়ে লজ্জাজড়ানো হাসিতে হেসে ওঠে ঘুঙুর।
রায়ানও মৃদু হেসে চেয়ে চেয়ে দেখে ঘুঙুরের মুখে খেলে যাওয়া ভালোলাগার অভিব্যক্তি। সেদিনের পর দু' জনার কাছে আসা- যাওয়ায় কেটে যায় বেশ কয়েকটি বছর। রায়ান পড়াশুনা শেষ করে একটি চাকরিতে জয়েন করে দুই পরিবারের সম্মতি নিয়ে তারা বিয়ে করে। আনন্দ আর খুশিতে ভালোই কাটছিলো তাদের দিনগুলো। তখন কথা ছিলো দুজনের প্রিয় বিষয়গুলো পাল্টে গেলেও, দুজনের মনের অমিল হলেও, দুজন দুজনকে কোনোদিনও ছেড়ে যাবে না। যদিও এই প্রতিশ্রুতিটুকু এখন কেবলই বাতাসে উড়ে উড়ে ফুরিয়ে যাওয়া কতগুলো টুকরো টুকরো শব্দ।
কেননা রায়ান আর ঘুঙুর একসাথে থেকেও তাদের দূরত্ব তৈরি হয়েছে যেন যোজন যোজন। বিশেষ কোনো প্রয়োজন ছাড়া রায়ানের ঘরেও ঢুকতো না সে। অপ্রয়োজনে কোনো কথা বলতো না। শেষ কবে একসাথে বেড়াতে গিয়েছে তারা, তাও এখন আর মনে পড়ে না ঘুঙুরের। শুরুর দিকে এ নিয়ে খুব মন খারাপ করতো সে, নির্ঘুম রাত কাটাতো চোখের জল ফেলে ফেলে। আবার এটাও ভাবতো, হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে। এই দুর্ব্যবহার, মন খারাপের সময়, অবিরত ঝরে যাওয়া চোখের জল সবকিছুরই অবসান হবে। কিন্তু কীভাবে? এই প্রশ্ন বারবার নিজের কাছে জানতে চেয়েও এর উত্তর কখনো পায়নি ঘুঙুর। কখনো কখনো মনে হতো, হয়তো কোনো যাদুর বলে একসময় সব ঠিক হয়ে যাবে। আসলে মানুষের আশেপাশে যখন শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না তখন মানুষ ম্যাজিকে বিশ্বাস করতে চায়। খড়কুটোর মতো কিছু একটাকে আঁকড়ে ধরে সামনে এগিয়ে যেতে চায়। বাঁচতে চায়। ঘুঙুরও হয়তো তাই চেয়েছিলো। কিন্তু না, গত কয়েক মাসেও স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বা কোনো যাদুর বলে তাদের ভালোবাসা আর পুনরুজ্জীবিত হয় না। একের পর এক নির্ঘুম রাত কাটিয়ে, বিষাদের ভার বয়ে চলাটা ঘুঙুরের জন্য একটা সময়ে অসহনীয় হয়ে পড়ে। তাছাড়া মন যাকে আর চায় না তার সাথে অনিচ্ছাকৃত এই সংসার সংসার খেলা বা একসাথে থেকে যাওয়াটাও তো নিজের এবং অন্যজনের জন্যও একধরণের শাস্তি বলেই ভেবে নেয় ঘুঙুর। তবুও অজানা কোনো কারণে কিংবা নিজের কাছে হেরে যেতে চায় না বলেই হয়তো তার বারবারই মনে হয়, রায়ান আজও ভোলেনি তাকে। যা কিছু ঘটেছে হয়তো কোথাও বুঝার ভুল ছিল। হতে কি পারে না এমনটা ? হতেও তো পারে। এসব কিছু ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার দৃষ্টি বাধা পড়ে পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া বিড়ালটির দিকে। এ বাড়িতেই থাকে সে। ওকে কোলে তুলে নিয়ে ওর শরীরে হাত বুলাতে বুলাতে জানতে চাইল, ‘কিরে পুষি তুই বল না, সত্যিই কি আমায় ভুলে গেছে রায়ান?’
ঠিক ওই সময়টায় কলিং বেল বাজে, চমকে উঠে ঘুঙুর। ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে গেছে। কোল থেকে বিড়ালটাকে মেঝেতে নামিয়ে দিয়ে দরজা খুলে দেখে- করিডোরের রেলিংয়ে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রায়ান। চোখের নিচে কালো দাগ, গালে-চিবুকে ফুটে উঠেছে নির্ঘুম রাতের চিহ্ন। আচমকা তাকে দেখতে পেয়ে কিছু সময় হতবাক হয়ে চেয়ে রইলো, অজান্তেই চোখ উপচে পানি আসছিল। সে চোখের পানি যেন গোপন থাকে তাই ঘুঙুর তার হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে তা মুছে নিলো। যেন রায়ানের প্রতি তার ভালোবাসার এই বহিঃপ্রকাশটুকু রায়ানের কাছে অপ্রকাশিতই রয়। দরজাটা বন্ধ করে ঘরের ভিতরের দিকে ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে খোলা চুলগুলো বেঁধে নিলো হাতের সাহায্যে। লম্বা ছিপছিপে শরীরটা সোফায় এলিয়ে দিলো। তার ঠিক পাশেই বসে রায়ান ঘুঙুরের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো--
‘বাবা, মা কেউ বাসায় নেই, দেখছি না যে।’
‘বড় মামার বাসায় বেড়াতে গেছেন।’
‘ও, তারপর তোমার কী অবস্থা? বেড়ানো শেষ হলো?’
‘বেড়াতে এসেছি, সেটা কেন মনে হলো তোমার?’ রায়ানের দিকে না তাকিয়েই সেন্টার টেবিলের উপর থেকে হাত বাড়িয়ে রিমোটটা তুলে নিতে নিতে বলে ঘুঙুর। রায়ান চুপ করে তাকিয়ে রয় তার দিকে। যেন বহুদিনের তৃষ্ণার্ত প্রেমিক তার প্রেমিকাকে দেখছে দু’চোখ ভরে।
রায়ানের সেই মায়াভরা চাহনিকে উপেক্ষা করে ঘুঙুর আবারও অভিমানের স্বরে বলে উঠে, ‘সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে তুমি তো ভালোই আছ।’
এবার রায়ান তার জায়গা থেকে সরে এসে ঘুঙুরের কাছ ঘেঁষে বসে। তার হাতটি নিজের হাতের মুঠোয় ভরে অপরাধীর স্বরে বিনীত ভঙ্গিতে বলে, ‘ঘুঙুর, আসলে গত কয়েকমাস আমি জবলেস ছিলাম। তুমি চিন্তা করবে ভেবে তোমাকে কিছুই জানাইনি। এমনকি চাকরি যে নেই, সেটাও যেন বুঝতে না পার তাই প্রতিদিন সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে পার্কে গিয়ে বসে থাকতাম, শপিং মলগুলোতে ঘুরে বেড়াতাম। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে যতক্ষণ জেগে থাকতাম, পুরোটা সময় অনলাইনে জব সার্চ করতাম। পাশাপাশি ফ্রি-ল্যান্সিং-এর মাধ্যমে টাকা উপার্জন করার কি কি উপায় আছে, যা আমাকে দিয়ে সম্ভব, সেটাও খুঁজতাম,অনলাইনেই।’
হতবাক হয়ে কথাগুলো শুনতে থাকে ঘুঙুর, রায়ানের দিকে তাকিয়ে থেকে। আর অজান্তেই তার চোখ ভিজে ওঠে। হাতখানিও জড়িয়ে রয়েছে তখনও রায়ানের হাতে। কান্না ভেজানো স্বরে সে বলে উঠে, ‘আমাকে বলতে তো পারতে।’
‘তোমাকে এইসব পেইন দিতে চাই নাই। তাইতো সংসারেও যখন যা প্রয়োজন হয়েছে, আমি সবই পূরণ করার চেষ্টা করেছি, তোমাকে না জানিয়ে ব্যাংক থেকে জমানো টাকা তুলেই।’
এবার রায়ানের মুঠো থেকে এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে অভিমান জড়ানো স্বরে বলে, ‘তার চেয়েও বেশি পেইন তুমি দিছ, খারাপ ব্যবহার করছ আমার সাথে।’
‘আমার মাথা ঠিক ছিল না। ইচ্ছে করে কিছু করিনি ঘুঙুর।’
‘হুম, বুঝলাম। কিন্তু আমি যদি এখন তোমার সাথে বাসায় যাই, তুমি তো জব না হওয়া পর্যন্ত দুর্ব্যবহারই করবা।’
রায়ান দু’হাতে আলতোভাবে ঘুঙুরের গাল ছুঁয়ে, চোখে চোখ রেখে বলে, ‘আর কখনো করবো না। তাছাড়া জব কনফার্ম হয়ে গেছে। এ্যাপোয়েন্টমেন্ট লেটারও হাতে পেয়েছি।’
গাল থেকে হাত দুটি সরিয়ে দেয় ঘুঙুর। রায়ান একটু থেমে আবারও বলে, ‘শুনো, এই শুক্রবারের টিকেট কনফার্ম করা আছে। হোটেলও বুকড করেছি। আমরা সমুদ্র দেখতে যাচ্ছি।’
‘আমরা? আমি কেন যাবো তোমার সাথে? আমার ভালোবাসায় তো তোমার দম বন্ধ হয়ে আসে।’
বলতে বলতে আবারো চোখ দুটো থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল ঘুঙুরের। জমে থাকা ব্যথার পুরনো স্মৃতিকে মনে করে আবার যেনো উসকে দিলো সে নিজেই, নতুন করে ।
‘আহহা। এমন করো না তো।’ এক হাতে ঘুঙুরের চিবুক তুলে ধরলো, চোখ মুছে দিলো অন্য হাতে। কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলল, ‘তোমার ভালোবাসা ছাড়া সত্যিই আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। চলো না প্লিজ, বাসায় চলো। ব্যাগ গুছিয়ে নাও...।’