Published : 25 May 2025, 01:41 PM
এক বোতল পেপসিই হচ্ছে বিধবা বি দাদি’র স্বর্গে পৌঁছে যাওয়ার টিকিট—যার জাদুতে তিনি ভুলে যান জীবনের যাবতীয় দুঃখ-দুর্দশা। অন্যদিকে, ধনী-অহংকারী শাজিয়া মক্কা সফরে গিয়ে বেমালুম একটি প্রতিশ্রুতি ভুলে বসেন, যা পরে তাকে তাড়া করে বেড়ায়। তরুণ আলেমের বিবাহিত জীবনে চরম অশান্তির কারণে হয়ে ওঠে গোবি মাঞ্চুরিয়ানের (ফুলকপি দিয়ে তৈরি খাবার) প্রতি তাঁর অতি আসক্তি। আর ওইসব মুসলিম নারী—যাদের স্বার্থপর স্বামীরা তাদের ছেড়ে গেছে। পরিবার তো দূরের কথা—ঈশ্বরের দ্বারেও তাঁরা বিন্দুমাত্র আশ্রয় বা সহানুভূতি প্রার্থনা করে পায় না।
এমন সব চরিত্র নিয়ে লেখা বানু মুশতাকের ছোটগল্পের সংকলন ‘হার্ট ল্যাম্প’ (প্রকাশক: পেঙ্গুইন র্যান্ডম হাউজ) । ১২টি ছোটগল্পের প্রতিটিতেই উঠে এসেছে কর্ণাটকের ছোট শহরে বাস করা মানুষের রোজকার জীবনের দুর্বলতা, দোষ-ত্রুটি-ভঙ্গুরতা। সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী এবং আইনজীবী হিসেবে বানু মুশতাক খুব কাছ থেকে তাদের দেখেছেন, তাদের যাপনকে অনুভব করেছেন।
লিঙ্গই যখন ধর্ম
বুকারজয়ী বানু আশির দশকে প্রথম নারীবাদী চিন্তাধারার সংস্পর্শে আসেন। ৭৭ বছর বয়সী লেখিকা আজ তাঁর মুসলিম ‘বোন’দের পক্ষে এক শক্তিশালী কণ্ঠস্বর যিনি বিশ্বাস করেন, মুসলিম নারীরা ঘুরেফিরে একের পর এক অবিবেচনাপ্রসূত পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার খেয়াল-খুশির শিকার হন। তাই ধর্মকে যখন নারীদের দমন-পীড়নের হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগানো হয়, বানু তখন দৃঢ়চিত্তে মুসলিম নারীদের পাশে দাঁড়ান। এর জন্য ভুগতেও হয়েছে তাকে। পড়েছেন ধর্মীয় গোঁড়ামি আর পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার তীব্র রোশানলে। তাঁর বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি হয়েছিল, এমনকি ছুরি নিয়ে হামলাও।
তাই তো, স্বাভাবিকভাবেই এই গল্পসংকলনের অন্যতম সেরা কাহিনী ‘ব্ল্যাক কোবরাস’ যেখানে কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে আমরা পরিচিত হই গৃহকর্মী আশরাফের সঙ্গে যে কিনা হঠাৎ করেই রাগে-ক্ষোভে-দুঃখে উন্মত্ত হয়ে স্থানীয় মসজিদে গিয়ে অসুস্থ শিশুসন্তানসহ আরও দুই সন্তানের জন্য ন্যায়বিচারের দাবি তোলে। তাঁর নির্দয়-অবিবেচক স্বামী, যে আরো একটা বিয়ে করেছে, নিজের পক্ষে রায় আনতে সংকীর্ণমনা মৌলভীকে ঘুষ দিতে পর্যন্ত রাজি হয়। কিন্তু যে নিজের অসুস্থ শিশু সন্তানের জন্য সিকি পয়সাও খরচ করতে চায় না। থু! (এই বইয়ের গল্পে ভারতীয় উচ্চারণে অনেক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যেগুলো স্থানীয় চরিত্রদের সঙ্গে দারুণভাবে মানিয়ে গেছে।)
তবে, বানু তাঁর গল্পের নাম ‘ব্ল্যাক কোবরাস’ রাখার মাধ্যমে আশরাফের অবিবেচক স্বামীর দিকে ইঙ্গিত করেননি। বরং গল্পের শিরোনামের সঙ্গে হুবহু মিলে যায় এমন এক চরিত্রকে হাজির করেছেন—যে সাপের মতো নিঃশব্দে পেঁচিয়ে আশরাফকে অন্ধকারের দিকে টেনে নেয়। এ গল্পের শেষটা ভীষণ করুণ। বানু যখন গোঁড়া পরিবার ও সমাজব্যবস্থার ঘুণেধরা পুরুষতান্ত্রিক আচরণের প্রতি তাঁর ক্ষোভ উগরে দেন, পাঠকের গলা পেঁচিয়ে তখন কুন্ডলীর মতো কান্না উঠে আসে।
এই বইয়ের আরেকটি ছোটগল্প ‘হার্ট ল্যাম্প’ আবর্তিত হয়েছে এমন একজন নারীকে ঘিরে—যে স্বামীর উপেক্ষা, ভালোবাসাহীনতা, আর দূরে ঠেলে দেওয়ার মতো নির্মম যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে নিজের গাঁয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার মতো ভয়াবহ সিদ্ধান্তের চূড়ায় পৌঁছে যায়।
দ্য ফেডারালকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বানু বলেন, “আমার চরিত্রদের কিন্তু ভুলেও দুর্বল মনে করা উচিত নয়।”
তিনি আরো বলেন, “আমার গল্পের নারী চরিত্ররা ভীষণ শক্তিশালী, কারণ তাঁরা বাঁচার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে অন্ধকারের গভীর খাদ থেকে উঠে আসা। বইয়ের শিরোনাম হিসেবে ‘হার্ট ল্যাম্প’ কথাটা বেছে নেওয়ার মাধ্যমে এই নারীদের জন্য আলো ও আশা ছড়িয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, যা দ্বিতীয়বার বেঁচে ওঠার কথাও বলে। আমার গল্পের নারীরা শেষ পর্যন্ত নিজেদের ভাগ্য মেনে নেয়, তবে উপলব্ধি করে—লিঙ্গই তাদের প্রকৃত ধর্ম। তাঁরা বুঝতে পারে, পরিবার বা ধর্মের ওপর নির্ভর করে কোনো লাভ নেই—এসব পুরোপুরি তাদের ব্যর্থ করছে।”
‘ব্ল্যাক কোবরাস’-এ শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর মতো করুণ পরিণতি ঘটে। কিন্তু আশরাফের দ্রোহ ও ত্যাগ আশপাশের অন্য নারীদের আলোড়িত করে। যাঁরা নেহাতই আর সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হয়ে বাঁচতে চায় না। বরং একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে নিজেদের সম্মান আদায় করে নেওয়ার সাহস খুঁজে পায়।
তাঁর রসবোধ
বানুর সব গল্পই কিন্তু নিপীড়িত নারীদের নিয়ে নয়। তাঁর জগতে অসহিষ্ণু-হিংসুটে নারীরাও থাকেন। যাদের দেখা আমরা পাই ‘আ ডিসিশন অব দ্য হার্ট’ গল্পে। বানু আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন যুক্তিহীন-খামখেয়ালি আখিলার সঙ্গে। আখিলার স্বামী ইউসুফ। স্বাভাবিকভাবেই ইউসুফ নিজের মা মেহবুব বি’কে ভীষণ ভালোবাসে। কিন্তু বিধবা মায়ের প্রতি ইউসুফের গভীর ভালোবাসা ঘিরে একধরনের অযৌক্তিক ঈর্ষায় আক্রান্ত হয় আখিলা। ইউসুফ একজন সদাচারী মানুষ। কিন্তু স্ত্রীর নিষ্ঠুরতায় হাঁপিয়ে ওঠেন। আখিলা একপর্যায়ে মেহবুব বি’কে ‘বেশ্যা’ বলেও অপমান করে। ইউসুফ শেষমেশ তাঁর নিরীহ মাকে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
এ ধরনের চিরাচরিত টানাপোড়েনের কাহিনীর ভেতর গল্পের এই রসিক মোড়টিতে এসে পাঠক এক ধরনের টক-মিষ্টি অনুভুতির স্বাদ পায়। যেখানে লেখিকা দেখান, ইউসুফ কীভাবে মায়ের একজন যোগ্য বর খুঁজতে হন্যে হয়ে ঘুরছে। বানুর কিছু গল্পে এমন হাস্যরসের উপস্থিতি চোখে পড়ে। যা তাঁর নিজ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির নির্যাস ছড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি গল্পের গভীরতা ও মাধুর্যকে আরও বেশি প্রাণবন্ত করে তোলে।
‘ফায়ার রেইন’ গল্পেও কমেডি অব এররের আদলে কৌতুকপূর্ণ এক আবহ তৈরি করেছেন লেখিকা। এক মৌলভিকে হঠাৎ করে এক মৃত মুসলমানের দেহ হিন্দু সমাধি থেকে তুলে এনে যথাযথ ধর্মীয় নিয়মে দাফনের ‘গুরু’ দায় কাঁধে তুলে নিতে দেখি আমরা। যদিও এহেন ‘পুণ্যকর্মে’ ঝাঁপিয়ে পড়ার আসল কারণটি হচ্ছে, পারিবারিক সম্পত্তিতে ছোট বোনের ভাগ চাওয়ার বিষয়টিকে পাশ কাটানো। শেষদিকে গল্পটি ভীষণ হাস্যকর এক মোড় এসে হাজির হয়।
“নারীবাদী লেখালেখি মানেই সবসময় হতাশা, দুঃখ বা সংগ্রামের গল্প হতে হবে—এমন নয়। আমাদের জীবনে যদি হাস্যরস না থাকে, তাহলে তো পাগল হয়ে যাবো,”— বানু এমনটাই মনে করেন। তাই তো বাস্তব কোনো ঘটনা বর্ণনার সময় তাঁর কথাবার্তায়ও মাঝে মাঝে দুষ্টুমিভরা রসিকতা ফুটে ওঠে, যা লেখিকার স্বভাবের মজার এ দিকটিকে সামনে আনে।
বানুর বিরুদ্ধে ফতোয়া
২০০০ সালে, মুসলিম নারীদের মসজিদে নামাজ পড়ার অধিকার রক্ষার দাবিতে সোচ্চার হওয়ায় বানুর বিরুদ্ধে তিন মাসের জন্য একটি ফতোয়া জারি করা হয়। “ছুরি নিয়ে আমার ওপর হামলার সবচেয়ে অদ্ভুত দিক হলো—আদালতের ভেতরে যে লোকটা আমার দিকে তেড়ে এসেছিল (যেখান থেকে আমার স্বামী আমাকে রক্ষা করেন), সেই লোকটাই পরে আমার বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়ায়। নিজের গ্রামে ফিরে যাওয়ার জন্য ৬০০ রুপি চেয়ে বসে। শেষমেশ আমার মেয়েটা মায়া দেখায়। আমাকে অনুরোধ করে, আমি যেন লোকটার বিরুদ্ধে মামলা না করি। আমি ওকে ছেড়ে দিই। পরে সে আবার আমার কাছ থেকে অর্থ ধারও নেয়,”— কৌতুকভরা বিস্ময়ে বললেন বানু। তাঁর জগতে এমন অদ্ভুত ঘটনা যেন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।
‘এ টেস্ট অব হ্যাভেন’ গল্পে আমরা পরিচিত হই সবার প্রিয় ‘চির কুমারী’ বি দাদির সঙ্গে। যিনি শৈশবে বিয়ের এক বছরের মাথায় বিধবা হয়ে ভাইয়ের বাড়িতে "ছায়ার মতো" জীবন কাটান। তিনি পেপসির প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছেন। যাদুকরি এই পানীয় তাঁর শূন্যতাকে পূরণ করে মৃত স্বামীর সঙ্গে তাঁর অদৃশ্য সংযোগ স্থাপনে সাহায্য করে।
“আমার দাদুর বোনের স্মৃতির ওপর ভিত্তি করে আমি বি দাদি চরিত্রটিকে তৈরি করেছি। এক বছরের মধ্যে তাঁর স্বামী মারা যান। আবার বিয়ে হওয়ার কোনো প্রশ্নও নেই। সে জীবনে কখনো সুখ দেখেনি। গল্পে, যখন তাঁর জায়নামাজটি ময়লা হয়ে যায়, তখন তাঁর এতোদিনের চাপা আবেগের বাঁধ ভেঙে পড়ে। চোখের জল আর থামতে চায় না, তাঁর ভিতরে একটা কিছু ভেঙে যায়,” বলেন বানু। যিনি তাঁর কল্পনা দিয়ে বি দাদির পেপসির প্রতি ভালোবাসার বিষয়টি সৃষ্টি করেছেন।
লেখালেখির প্রক্রিয়া
লেখালেখির অনুপ্রেরণা নিয়ে বানু জানান, “কিছু গল্প আমার মনের গভীরে বীজের মতো ছড়িয়ে থাকে। দুই থেকে তিন বছর ধরে বৃদ্ধি পায়। পরিপক্ক হয়। তারপর গল্পের আকার নেয়। প্রতিটি গল্পের জন্য আমি আমার মন-প্রাণ উড়াজ করে দেই, কারণ তা আমার মনোজগতের কিছু না কিছুকে নাড়া দিয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত আমি তা গল্প আকারে গেঁথে না ফেলি, ঘুমাতে পারি না।”
বানু এ পর্যন্ত ৬০টির মতো গল্প লিখেছেন। নিজের লেখালেখির প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, “আমি কোনো পুনঃলিখন করি না। কোনো গল্প লেখার পর ছয় মাসের জন্য তা ‘হিমাগারে’ রেখে দিই। তারপর আবার বের করি। ছাপানোর আগে গল্পটি আরেকবার পড়ি। প্রয়োজন হলে পরিবর্তন করি।”
সম্প্রতি বেঙ্গালুরুতে এক অনুষ্ঠানে আমরা বানুর সঙ্গে দেখা করি। গোলাপি সালোয়ার-কামিজ পরিহিত বানু যেন ভীষণ সাদামাটা একজন মানুষ। সবকিছু বেশ খুঁটিয়ে দেখেন। মনের কোণে যত্ন করে রেখে দেন। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়ে যদিও তিনি ভীষণ “উচ্ছ্বসিত”, তবে খ্যাতির ব্যস্ততা তাঁর জীবন-ছন্দে খানিকটা ছেঁদ ঘটাচ্ছে।
আদালতে আইনজীবী হিসেবে নিয়মিত কাজ আর মানবাধিকার কর্মী হিসেবে সক্রিয় রয়েছেন বলে মাঝরাতে এখনও নারীরা তাঁর সাহায্য চাইতে আসেন। ফেব্রুয়ারিতে বুকার পুরস্কারের দীর্ঘ তালিকা ঘোষণার পর থেকেই তিনি সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাৎকার আর নানা অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন।
"জুনে আবার লন্ডনে যেতে হচ্ছে জয়পুর সাহিত্য সম্মেলনে অংশ নিতে। এরপর কলকাতায় বেঙ্গল ক্লাবে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেব। এদিকে আমার সাহিত্যিক এজেন্ট ইংরেজিতে অনুবাদের জন্য নতুন গল্প চেয়ে বারবার চাপ দিচ্ছেন,”— হেসে বলেন তিনি।
স্বীকারোক্তির সুরে বলেন, “কন্নড় ছোট গল্পসংকলনের সাত নম্বর বইটির শেষ গল্পটি শেষ করারই সময় মিলছে না এখন আমার হাতে!"
বান্দায়া সাহিত্য আন্দোলন থেকে প্রভাবিত
বানুর জীবনের পুরুষরা কিন্তু তাঁর ছোটগল্পগুলোর পুরুষ চরিত্রদের মতো নিষ্ঠুর-অবিবেচক নন। শিমোগার স্বাস্থ্য পরিদর্শক হিসেবে কর্মরত তাঁর বাবা চাইতেন মেয়েকে উন্নত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে। বানুকে তিনি কন্নড়-মাধ্যম কনভেন্ট স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন। বানু বলেন, "বাবা যদি আশপাশের লোকদের কথা শুনতেন—যাঁরা বলছিল, ‘মুসলিম মেয়েদের উর্দু স্কুলেই পড়া উচিত, কন্নড় শেখা নয়’—তাহলে আমি আজকের এই বানু হতে পারতাম না।” বাড়িতে তিনি দক্ষিণ ভারতীয় উর্দু (Dakhni Urdu) ভাষায় কথা বলেন।
লেখালেখি আর আইন নিয়ে পড়তে বানুকে তাঁর স্বামীই উৎসাহ যুগিয়েছেন। "ফ্যাসিবাদী শক্তি" যখন বানুকে তালাক দেওয়ার জন্য তাঁর স্বামীকে চাপ দিতে থাকে, তিনি তখন বানুর পাশে দাঁড়ান। পরবর্তীতে বান্দায়া সাহিত্য আন্দোলনের নেতা বারাগুরু রামাচন্দ্রাপ্পার মতো লেখকেরা মোল্লাদের সঙ্গে কথা বলে বানুর ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করাতে সাহায্য করেন। বানু কী অ্যাকটিভিস্ট না লেখক—কোনটা আগে? উত্তরে তিনি বলেন, দুই-ই। আর এটাই বান্দায়া সাহিত্য আন্দোলনের মূল স্লোগান—"যদি আপনি লেখক হন, তবে আপনি যোদ্ধাও বটে।"
আশির দশকে, তাঁর সময়ের অন্যান্য অনেক তরুণের মতো বানুও কর্ণাটক জুড়ে ছড়িয়ে পড়া বিপ্লবী আন্দোলনগুলো থেকে অনুপ্রাণিত হন। তিনি বলেন, “আমি বান্দায়া সাহিত্য আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম, কারণ তা গল্প ও কবিতার মাধ্যমে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাত।” এই আন্দোলন থেকেই তিনটি সাহিত্যের ধারা গড়ে ওঠে—দলিত সাহিত্য, নারীবাদী সাহিত্য এবং মুসলিম সাহিত্য। কন্নড় ভাষার নারী লেখকরা তখন নারীবাদী চিন্তাভাবনা নিয়ে লিখতে শুরু করেন। তাঁরা ভাবতে থাকেন—এই ভাবনাগুলো পরিবারে, সাহিত্যে কীভাবে প্রয়োগ করা যায়। আর মুসলিম লেখকেরাও লেখার বিষয় হিসেবে নিজেদের অভিজ্ঞতাগুলোকে তুলে ধরতে থাকেন,” ব্যাখ্যা করেন বানু।
“কন্নড় সাহিত্যে তখন নানা রকম কণ্ঠস্বর উঠে আসছিল, তাই আমার লেখাতে মুসলিম নারীর কণ্ঠস্বর তুলে আনার বিষয়টি ছিল খুব স্বাভাবিক,” বলেন বানু।
তিনি আরো যোগ করেন, “আমি লিখেছি সেই জগত নিয়ে যেটা আমি সবচেয়ে ভালো জানি—আমার চারপাশের প্রতারণা, করুণ পরিণতি আর সুখ-দুঃখের গল্প। আমার মহল্লার রাজনীতি, স্থানীয় মসজিদের ভেতরের কথা। আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী হিসেবে কাজ করার পথে যাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে—আমি তাদের নিয়েই লিখেছি।”
ছোটগল্পের দীর্ঘ ঐতিহ্য
কন্নড় সাহিত্যে নারীদের ছোটগল্প লেখার দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে—এমনটাই মনে করেন কন্নড় ভাষার স্বনামধন্য লেখক বিবেক শানভাগ। তিনি বলেন, “এই ঐতিহ্যের শিকড় ১২শ শতকের কবি আক্কা মহাদেবীর সময় পর্যন্ত বিস্তৃত। তাঁর রচিত বচনগুলো (আত্মদর্শন ও আধ্যাত্মিক ভাবনায় পূর্ণ শ্লোক) সময়ের অনেক আগে থেকেই নারীবাদী চেতনা দিয়ে পূর্ণ ছিল। তিনি তখনই জাত-পাতের অবসান চেয়েছিলেন। তাঁর লেখা ছিল গভীর ও দার্শনিক। এটাই কন্নড় সাহিত্যের শক্তিশালী ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। যা এই সাহিত্য পড়ে বড় হয়ে ওঠা তরুণ মনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। বানু মুশতাকের মতো লেখকের আবির্ভাবও এভাবে, এই ধারার মাধ্যমে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই,” দ্য ফেডারালকে বলেন শানভাগ।
লেখক বিবেক শানভাগ আরো বলেন, বানুর পাশাপাশি কন্নড় সাহিত্যে আরও অনেক ছোটগল্পকার রয়েছেন। যেমন, বৈদেহী (জনপ্রিয় লেখক জানকি শ্রীনিবাস মূর্তির ছদ্মনাম) হলেন কন্নড় সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জীবিত সমসাময়িক লেখক। এছাড়া, এম কে ইন্দিরা (যাঁর উপন্যাস থেকে নির্মিত চলচ্চিত্র জাতীয় পুরস্কার জিতেছিল), ভীনা শান্তেশ্বর, অনুপমা নিরঞ্জন—এঁরাও কন্নড় সাহিত্যে দাপটের সঙ্গে লিখে গেছেন। তাঁদের অনেক লেখার মূল বিষয়বস্তু পুরুষতান্ত্রিকতা। পারিবারিক জীবন, বিয়ে, আর সমাজের বিধিনিষেধ নিয়ে লিখতে সাহস লাগে। যে সাহস তাঁদের আছে।
লঙ্কেশ পত্রিকায় সাংবাদিকতা দিয়ে পরিচিতি পাওয়া বানু একজন সক্রিয় মানবাধিকার কর্মীও—যা তাঁর লেখায় স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে, বলেন বিবেক শানভাগ। তিনি আরো যোগ করেন “বানুর গল্পগুলো আমাদের এমন এক পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার গভীরে নিয়ে যায়, যেখানে পুরুষরা ধর্ম, সংস্কৃতি, অর্থ এবং মানসিক চাপের মাধ্যমে নারীদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালায়। তিনি মুসলিম নারীদের জীবন থেকে উঠে আসা অনেক হৃদয়বিদারক গল্প বলেছেন। কিন্তু তাঁকে আমি শুধু ‘মুসলিম নারী লেখক’ হিসেবে অ্যাখ্যায়িত করতে রাজি নই।”
“বছরের পর বছর ধরে কন্নড় ভাষার নারী লেখকরা তাঁদের চারপাশের জীবনকে গভীর নিপুণতা আর শৈল্পিক শক্তি দিয়ে তুলে এনেছেন,” বলেন বিবেক শানভাগ। “ইংরেজি অনুবাদ তাঁদের লেখাকে এখন বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় ও দৃশ্যমান করে তুলেছে ঠিকই, কিন্তু এতে কন্নড় সাহিত্যে যা কিছু রয়েছে তার মূল্য একটুও কমে না—কারণ এই ভাষাগুলোর নিজস্ব ঐতিহ্য আছে,” তিনি যোগ করেন।
অনুবাদের দিকে অনেক বেশি জোর দিতে হবে
ভারতের নারী লেখকদের সাহিত্যকর্ম অনুবাদের জন্য এখনই জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন—এমনটাই মনে করেন বানু। তাঁর অনুরোধ, এই কাজটা যেন যুদ্ধকালীন সময়ের মতো করে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে শুরু করা হয়। “সব দরজা-জানালা খুলে দেওয়া উচিত বিশ্বের সামনে। কারণ, কন্নড় সাহিত্য আসলে বিশ্বমানের। পশ্চিমা দুনিয়া এখনো ভারতীয় নারীদের সাহিত্যকে সত্যিকার অর্থে চিনে ওঠেনি। এ কারণেই তাঁরা আমার লেখাকে আলাদা মনে করেছে এবং আমাকে বেছে নিয়েছে,” বলেন বানু।
তিনি মালায়ালম লেখিকা সারা জোসেফ এবং তেলুগু নারীবাদী কবি ও লেখক ভোলগার (পোপুরি ললিতা কুমারীর লেখক নাম) অনুরাগী। “তাঁরা সবাই চিন্তা, বুদ্ধিমত্তা ও শিল্প প্রকাশের শৈলীতে অনেক এগিয়ে আছেন এবং বৈশ্বিক স্বীকৃতির জন্য সবচেয়ে বেশি যোগ্য ও উপযুক্ত,” দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন বানু।
মুসলিম রীতি-রেওয়াজ
‘হার্ট ল্যাম্প’ এ মুসলিম প্রথা নিয়ে বেশ কিছু গল্প আছে। যেমন ‘রেড লুঙ্গি’-তে ছেলে বাচ্চাদের খৎনা নিয়ে লেখা হয়েছে। লেখক যেখানে রসিক কথোপকথনের মধ্য দিয়ে তাদের ভয়কে ফুটিয়ে তুলেছেন। আছে ‘দ্য শ্রাউড’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র শাজিয়ার মক্কা সফরের দুর্দান্ত সব বর্ণনা।
“আমাদের রীতি-নীতির বিভিন্ন দিক রয়েছে—বিশেষ করে মৃতদের সংস্কার প্রথা নিয়ে আমি আরও অনেক কিছু লিখতে চাই। ‘দ্য শ্রাউড’ গল্পে মক্কা থেকে আনা কাফনের কাপড় নিয়ে লিখেছি, যা সবচেয়ে পবিত্র বলে মনে করা হয়। মুসলিমরা এটা কিনে নিরাপদে রেখে দেন। সন্তানদের বলে রাখেন, মৃত্যুর পর দাফনের সময় ব্যবহার করতে। আমাদের ঐতিহ্য নিয়ে লেখার জন্য অনেকেই আমার সমালোচনা করেন। আমি তাদের সবসময় বলি যে, একজন সমালোচক হিসেবেই আমি দু’পক্ষের ফাঁকটা মেটাচ্ছি।”
বানু মুসলিম নারীদের সংস্কার প্রসঙ্গে বলেন, “মুসলিম নারীরা আজকাল আগের মতো পুরুষতন্ত্রের কাছে নতজানু নন। তবে এখনও অনেকেই আছেন, যাদের এই দমনমূলক বন্ধন থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। কিন্তু কে তাদের সান্ত্বনা দেবে?” তাঁর মতে, রাষ্ট্র এই বিষয়ে কোনও প্রকৃত সহায়তা করছে না, বরং মুসলিম নারীদের বিষয়টিকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করছে যা তাদের জন্য আরও বেশি ক্ষতিকর। তিন তালাক আইনকেও তিনি খারিজ করে দেন। "এটি এমন একটি আইন যা যৌতুক নিষিদ্ধকরণ আইনের মতই কার্যকর করা সম্ভব হয় না,” বলেন তিনি।
“আমাদের দেশে তিন তালাক আইন আছে। কিন্তু পণ-নিষিদ্ধ আইনের মতো এটাও নারীকে সুরক্ষা দিতে পারে না। নিগ্রহের শিকার হয়ে মেয়েটি যখন আত্মহত্যার মতো চরম সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়, তখন কেবল আলোচনা হয়” স্পষ্টভাবে বলেন বানু। আরো যোগ করেন, “এই আইন মুসলিম নারীদের জন্য কোনো বাস্তব আশার জায়গা তৈরি করে না, কারণ এগুলো বাস্তবায়নযোগ্য নয়।” তবে শেষ পর্যন্ত মুসলিম নারীরা নিজেদের লড়াইটা নিজেরাই লড়তে জানে। বানু বিশ্বাস করেন, নারীরা এ লড়াই চালিয়ে যেতে সক্ষম।