Published : 26 May 2025, 01:28 PM
তারপর নগ্নসন্ধ্যার ফুলগুলো একে একে ঝরে পড়লে অন্ধকারের আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। দুর্ভেদ্য একটি দেয়াল ঠেকে। সে দেয়ালের অপর পাশে আরও তুমুল আঁধার।
আমরা ক'জন অন্তর্মুখী বিকল্প সন্ধ্যায় নিজেদের পানীয়ের জন্য বাজি রাখি একেকটা ঝরে পড়া ফুল। ফুলগুলো দলাইমলাই করে আমাদের ঘোড়সওয়ার মন টগবগ টগবগ করে। অন্ধকারে দিকচিহ্নহীন ছোটার প্রান্তর আরও বেশি মুমূর্ষু, আরও বেশি বন্ধুর হয়ে উঠে। আমরা ঘাসের মাঠে ঘাস হয়ে, ক্লান্ত হয়ে ফুলের পিঠে পিঠ রেখে শুয়ে থাকি। পিঠ আমাদের দেয়ালে ঠেকে। মাটির দেয়াল, পৃথিবীর ঘনত্বের কাচ।
শমশের বলে, তাহলে বিকল্প সন্ধ্যার আভা নিভে যেতে যেতে আমাদের যে সতর্ক করেছিলো তা আমরা মানছি না?
নটরাজ বলে, না মানার কিছু নেই। অন্ধকার অনিবার্য ছিল এবং এটির চলমানতা হ্রাস করতে আমরা আমাদের বুকের পিদিম জ্বেলে ধরতে পারি।
পিদিমের আলো কি সব জায়গায় পৌঁছবে? বলল কাদির। তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে নটরাজ আবার বললো, এ জন্যই তোমার ঘোড়ার ঠ্যাং ভাঙে আর তুমি নুয়ে পড়ো ক্লান্ত সহিস।
আমি বললাম, নটরাজ, নটরাজ! এভাবে না। সে আমার দিকে বিস্ময়মুখে চাইলো। আমি অন্ধকারে তার নিঃশ্বাসের সুগভীর যন্ত্রণা উপশম করতে ক্লিক ক্লিক করে মুঠোফোনে তার ক'টি ছবি তুললাম। ছবি নয়, যেনো ভাস্কর্য। নক্ষত্রপোড়া মুখ। মদক্লান্ত চোখ, আর গাঁজায় ফুলে ওঠা কপালের শিরা। তীক্ষ্ণ তিরের মতো দাড়ি, আর মাথায়...মাথায় কি চে-টুপি ছিলো?
নটরাজ আমাদের সবার মুখের ওপর নিজের আধিপত্য বিনয়ের সাথে ছড়িয়ে দিয়ে বললো, এখন থেকে অন্ধকারই আলোর খোরাক, আর রাত শেষেই তো সূর্যটা ওঠে।
এ আঁধার কাটবে কতদিনে? আমি প্রশ্ন করলাম। তখন, জমাট অন্ধকারের ভেতর থেকে একগুচ্ছ বর্ষার ফলকের হৈ হৈ (শোনা যাচ্ছিল শো শো, হাউমাউখাউ) করে কজন উঠতি বয়সের ছেলে সে অন্ধকার বূহ্যের ভেতর প্রবেশ করে। তাদের হাতে তরবারি, হাতে আগুন। অথচ তরবারি কাটে না সন্ধ্যা, মশাল দূর করে না অন্ধকার। যেন তাদের ঘনত্বে অন্ধকার আরও সমৃদ্ধ হয়েছে মাত্র। আমরা ভয় পেলাম। নটরাজ ভয় পেলো না। আরেহ, এরা এলাকার পোলাপান। অমাবস্যা উদযাপনে এসেছে।
অমাবস্যার আবার উদযাপন! হুঁহ!—শমসের বলে। এবার নটরাজ একটু নরম হয়—'কী করবেন? ওরা চাঁদ ও সূর্যকে অস্বীকার করেছে। নিভিয়ে দিয়েছে যত আলো। এমনকি পাওয়ারপ্লান্টগুলোকেও ধ্বংস করেছে।'
'ধ্বংসযজ্ঞ কি অনিবার্য ছিলো?' আমি প্রশ্ন করলাম।
নটরাজ আমতা আমতা করে 'তা হয়তো ছিলো না। কিংবা ছিলো—আমাদের জানা নেই।'
'না জানতে পারেন, আপনি, আমরা নই।' কাদির প্রায় ক্ষেপে গিয়ে বলে।
শমশের কাদিরের দিকে চেয়ে হাসে। অন্ধকারে তার হাসি দেখা যায় না। মিছে মরা স্বপ্নের মতো ধ্রুপদ অলংকার তুলে হাসি হারিয়ে যায় ঝুপ করে অন্ধকারের অতল গহ্বরে। আমরা কজন ভেসে ওঠার কথা চিন্তাও করতে পারি না। লেপ্টে থাকি। আমাদের পানীয়ের গেলাস পূর্ণ হতে থাকে আর আমরা পরস্পরকে ফিরিয়ে দেই সেই গেলাস, জমাট অন্ধকার দিয়ে যা পূর্ণ হয়েছে।
মাঠের অপর পাশের পোলাপানগুলো সমবৃত্তীয় সন্ধ্যায় একটা অমাবস্যা উৎসবের প্রস্তুতি নিতে থাকলে আমরা ফুলগুলো, ভুলগুলো অন্ধকারের অপর পৃষ্ঠায় ছুঁড়ে দিতে চাইলে ফুলগুলো ধীরে ধীরে বিলীন হতে থাকে। কিন্তু আমাদের ভুলগুলো অন্ধকারের ঘনত্ব বাড়িয়ে আমাদেরকে আরও মুমূর্ষু, আরও উর্ধ্বশ্বাসমুখী করে দেয়। আমরা হাঁসফাঁস করি। একবিন্দু দম আটকানো জীবন ছন্নছাড়া পাখির মতো নিভন্ত আগুনের উন্মাদনায় ডানা তার হারিয়ে ফেলে। ঘোড়াগুলোর পা জমে আসে। মাঠের ঘাসগুলো হয়ত কালো কালো পাথর হয়ে গেছে এতক্ষণে। এতক্ষণে যে বৃষ্টি, মেঘ নয়, আগুনের...আর রক্তের। সেসব বৃষ্টিরেখা মুছে যাবার পরই তো আসে তুমুল আঁধার, নাকি? সেসব জানতে প্রশ্ন করা লাগে না। বিষণ্ণ সন্ধ্যার মৃতভাষা যে কেউ পড়তে পারে চাইলে।
জঠর যন্ত্রণায় মাতৃগ্রহটি একটি অসমতল আঁধারের ভেতর ঘুরপাক খেতে খেতে হেসে উঠে। আমরা সে হাসির আতঙ্ক টের পাই।
নটরাজ আমাকে বলে, 'আপনিও তো ইতর কম না। কেমর অন্তরালে মুখ লুকিয়ে আমাদের ইতরামিগুলো দেখে যাচ্ছেন।'
আমি মুচকি হাসলাম। নিজের হাসি অন্ধকারের হাসির ভেতর পড়ে আরও কোনো খাদ তৈরি করে কি না ভেবে ঢোক গিলে, গিলে ফেললাম হাসিটাকে এক চুমুক পানীয়ের সাথে। লেংটা একটা থুথু ফেললাম দূরের প্রান্তে। শমসের একটু ওঠে ঘোড়াজীবনের দলাইমলাই করতে চাইলো। নিঃসন্দেহে সহিস অমতে ছিলেন। শরীর চললো না। সে ফিরে এসে ঘাসের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লো প্রায়।
কাদির একপাক্ষিক ভাবে দোষারোপ করতে চায় নটরাজকে। 'এ অন্ধকারে তার ইন্ধন ছিল।' ছিলো, সেটা আমরাও জানি। কিন্তু নটরাজ এখন অনুতপ্ত —তাও ভাবতে পারি। নটরাজ অবশ্য সন্ধ্যাটাকে ফু দিয়ে উড়িয়ে দিতে চাইলে আমি না করতাম না। কিন্তু জেঁকে বসা অন্ধকার তার কোমলেও হয়তো আঘাত হানছে। হয়তো ভাবাচ্ছে তাকে। কি জানি, নাও ভাবতে পারে। নটরাজ যেই ছেলে, নিজের ভাবনাটা সে ধরে রাখতে চাইবে।
চাঁদটাকে ঢেকে ফেলবার আগে, আমি দেখেছি উৎসাহ নিয়ে নটরাজ মেঘের চাদর বিছিয়ে দিচ্ছে আকাশ জুড়ে। আমি দেখেছি, সে, তার সাঙ্গপাঙ্গরা —অবশ্য তার কোনো সাথীসঙ্গী নাই, জনম দুঃখী, একা সে—কিভাবে কৃষ্ণবিবর থেকে ঘাড়ে, পিঠে বয়ে এনেছে আঁধার। সব দেখেছি। তাদের মুখগুলো অন্ধকারে মাখামাখি হতে দেখেছি, দেখেছি তাদের রক্তগুলো বিশ্বাসঘাতকের কালো রক্ত বনে যেতে। মানুষের মুখগুলো কত সহজেই হায়েনায় বিবর্তিত হয়—দেখেছি। অবাক হয়ে দেখেছি, সে সবে নটরাজের ইন্ধন ছিল, উৎসাহ ছিল, প্রশ্রয় ছিল। একপ্রকার এ প্রলয়ের যোদ্ধা ভাবলেও তাকে অবিচারে দণ্ডিত করা হবে না। সে থাকে, সে ভাবে সে থাকে গ্রামে। গ্রামের একটি কণ্ঠ বিশ্বকণ্ঠ হয়ে যায়, যেতে পারে, তা এই নাক্ষত্রিক সংযোগে না ভাবার তার কারণ ছিল না। হয়তো বুঝেশুনেই সে অংশী হয়েছে। দেখলাম অন্ধকারটা সেও কাজে লাগাতে চায়। তার কথাবার্তায় অন্তত এ রকমই মনে হয়। আমরা তাকে কথা বলতে দিলাম।
আমাদের ঘোড়াগুলো শ্রমক্লান্ত হলো। নটরাজের কথা ফুরালো।
ঝরে পড়া ফুলগুলোর পাপড়ি বিন্দু থেকে বৃহৎ অংশে, ছড়িয়ে, মেখে ডুবে যেতে থাকলো অন্ধকারে। আমরা চেয়ে চেয়ে দেখলাম। শাদা ধবধবে পাপড়িগুলো শেষবিন্দু চাঁদের আলো বাঁচিয়ে রাখার তাগাদায় নিজেদেরকে ক্ষয় করে, ডুবিয়ে ভিজিয়ে এবং আমাদেরকে ভিজিয়ে মজে যাচ্ছে। আমাদের চোখদুটো কি ভেজা? অন্ধকারে ঠাহর হয় না। পাগলের মতো হাতড়াই, আমরা একেকজন অপরজনের নাগাল পাই না। তুমুল অন্ধকারের ভেতর অমাবস্যা উৎসব জমে ওঠে। ছেলেগুলো হল্লা করছে। অন্ধকারে কাটাকুটি করছে নিজেদের। ভুল দানে নিজেদের জুয়ায় ফাঁসছে...হো হো করে হেসে উঠছে আবার।
নগ্ন সন্ধ্যায় এতসব উৎসবের ভিড়ে, নটরাজের মুখটাকে কি চেনা যায়?