Published : 24 May 2025, 01:26 PM
বহুবর্ণিল চারিত্র্যবৈশিষ্ট্যে অনন্য ও ব্যতিক্রমী ছিলেন বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। দিলখোলা এই মানুষটি ছিলেন দারুণ কৌতুকপ্রবণ, ব্যঙ্গনিপুণ। রসেবশে অতুলনীয় এক মনকাড়া ব্যক্তিত্ব। বড়ো মজলিশি মানুষ ছিলেন তিনি। আড্ডা আলাপে মশগুল হয়ে যেতেন, মাতিয়ে রাখতেন সবাইকে। দীর্ঘসময় বাকস্তব্ধতা না থাকলে আমরা অবশ্যই আরও ঋদ্ধ হতে পারতাম কবির জীবন ও কাজের ঐশ্বর্য-সম্পদ থেকে। যেটুকু সময়ই তিনি ছিলেন সৃষ্টিশীল, সরব-- সে সময়টাকে তিনি ফুলে ফসলে ভরিয়ে তুলেছেন। অবিশ্বাস্য দ্রুততায় ব্যাপকভাবে তাঁর বহুমাত্রিক অবদানে সমৃদ্ধ হয়েছে বাংলা ভাষার সাহিত্য সংস্কৃতি সংগীতজগৎ। নজরুল ছিলেন আড্ডা জমানোর ব্যাপারে ওস্তাদ। মধ্যমণি হয়ে উঠতেন অবলীলায়। তাঁর রঙ্গরস উপভোগ করতেন সকল বয়সী মানুষ। গৌরচন্দ্রিকা আর না বাড়িয়ে নজরুল-রস আস্বাদনে আমরা এবার প্রবৃত্ত হবো।
*
কবি সুফিয়া কামাল ছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্নেহধন্যা। কবিকে দাদু বলে ডাকতেন সুফিয়া কামাল। প্রায়ই তাঁদের কলকাতার বাড়িতে যেতেন কবি। বসতো জমজমাটি গানের আসর। জম্পেশ সেই আয়োজনে শরীক হতেন অনেকে। সাহিত্য সংগীত অনুরাগীরা তো নজরুল সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য উন্মুখ ব্যাকুল থাকতেন সর্বদাই। একসময় নজরুলের পেছনে গোয়েন্দা লাগে। লাগবেই। বিদ্রোহী কবি বলে কথা। সাহিত্য সংগীত অনুরাগীদের সঙ্গে মিলেমিশে গোয়েন্দারাও সেই আড্ডা মজলিশে যোগ দিতেন। নজরুল ঠিকঠিকই টের পেতেন সেটা। একবার এক ভদ্রলোকের মুখের ওপর কবি তাঁর কবিতা আওড়ালেন। মোক্ষম সেই কবিতাটির চরণ হলো ‘তুমি টিকটিকি জানি ঠিকঠিকই।’ লোকটি ধরা খেয়ে রীতিমতো অপ্রস্তুত। মুখ লাল করে উঠে গেল।
ব্যাপারটা কিশোরী সুফিয়া কামালের দৃষ্টি এড়ায়নি। অবাক হয়ে তিনি কবিকে জিগ্যেস করলেন,
আচ্ছা দাদু, তুমি একে চিনলে কী করে?
নজরুল উত্তর দেন,
গায়ের গন্ধে। বড় কুটুম যে!
*
কবির অনুজপ্রতিম বন্ধু খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীনের বাড়ির একটি ঘটনা। নজরুল তখন থাকতেন কৃষ্ণনগরে। আর, মঈনুদ্দীনের আস্তানা হচ্ছে কলকাতার বেচু ঠাকুরের গলিতে। কারমাইকেল কলেজের হোস্টেলের পেছনে। একদিন দাওয়াত করা হলো কবিকে। সন্ধ্যা হয়ে এলো। কবি এলেন। মঈনুদ্দীন যা উদ্যোগ আয়োজন করেছেন, তা খুব বেশি নয়। তবে অন্যান্য দিনের চাইতে একটু ভালো।
কবি এসেই সোজা ঢুকে গেলেন রান্নাঘরে। তারপর এপাশ ওপাশ দেখতে লাগলেন। মঈনুদ্দীনের কাছে জানতে চাইলেন,
এটা কী রে?
রান্নাঘর। মঈনুদ্দীন উত্তর দেন।
আর ওটা কী?
ওটা হচ্ছে পায়খানা।
হাস্যরসিক নজরুল স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলে ওঠেন,
দূর শয়তান। পায়খানা কী রে? বল ‘যায়খানা’। খানা তো ওখান দিয়েই যায় রে!
বলে সেই বিখ্যাত প্রাণখোলা অট্টহাসি নজরুলের। আচমকা হাসির দাপটে জানালার কার্নিশে বসে থাকা পায়রাগুলো ভয় পেয়ে উড়ে গেল ঝটপট।
*
কবি অনুরাগীদের মধ্যে একজন ছিলেন অবাঙালি। তাকে নিয়ে ঘটনা। লোকটি নজরুলের বেশ ভক্ত। কবিকে তিনি অনেকসময় নানাভাবে সাহায্য সহযোগিতা করতেন। একবার কবির কলকাতার বাড়িতে কয়েকজন মেহমানের সঙ্গে কবি গল্পগুজব করছিলেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ওই অবাঙালি ভদ্রলোকও। এক পর্যায়ে তার সঙ্গে কবির হিন্দি বনাম বাংলা ভাষা নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা হচ্ছিল। লোকটি হিন্দি ভাষার পক্ষ নিয়ে বলছিল। কবি হাসতে হাসতে বললেন তাকে,
আরে যাও যাও। তোমাদের হিন্দি তো কুকুর বেড়ালের ভাষা।
একথা শুনে বেশ বেজার হয়ে গেলেন লোকটি। মন খারাপ হলো তার। ক্ষুন্ন হয়ে বললেন,
কেঁও?
ব্যস। কবিকে আর পায় কে! সঙ্গে সঙ্গে তিনি বলে উঠলেন,
এই দ্যাখো, কুকুরের ডাক ডাকলে!
ভদ্রলোক রাগ করলেন না। হেসে বললেন,
হুয়া হুয়া!
নজরুল বললেন,
ওই দেখ তুমি শেয়ালের ডাক ডাকলে। কী,আমি ঠিক বলিনি?
নজরুলের কথায় উপস্থিত সবাই ভীষণ মজা পেলেন। হেসে ফেললেন তারা।
*
গ্রামোফোন কোম্পানিতে একবার একটি লোক এলো। উদ্দেশ্য, গান দেওয়া। তাকে পাঠানো হলো কবি কাজী নজরুল ইসলামের কাছে। আগত ভদ্রলোকের গানের দৌড় আসলেই কদ্দূর, সেটার পরীক্ষা দেয়ার জন্যে।
বেশ। লোকটি হারমোনিয়াম নিয়ে বসলেন নজরুলের সামনে। গান গাওয়ার নামগন্ধ নেই। নানারকম কথা বলতে শুরু করলেন। গান শিখেছেন কার কাছে, কবে কোনজন তার গান শুনে প্রশংসা করেছেন, তার পাণ্ডিত্য কতটা গভীর ইত্যাকার প্রসঙ্গ। কথা চলছিল। এক ফাঁকে লোকটি কবিকে জিগ্যেস করে বসলেন,
আচ্ছা,আপনি কী ধানশ্রী ভৈরবী রাগের গান শুনেছেন? শোনেন নি বোধহয়। খুব রেয়ার। কেবল আমার কাছেই আছে।
এইভাবে কাটছিল সময়। গান গাওয়ার পরিবর্তে চলছিল তার বকবকানি।
লোকটির ওপর মহা বিরক্ত হয়ে নজরুল বললেন,
আপনি তো দেখছি একটা জানোয়ার লোক।
কী, কী বললেন? খেপে উঠে বলে লোকটি।
নজরুল তখন বলেন,
না, না। অন্য কিছু মনে করবেন না আপনি। দেখলাম, আপনি অনেক কিছু জানেন। তাই আপনার সম্পর্কে ‘জানোয়ার’শব্দটি প্রয়োগ করেছি।
লোকটি এবার চুপ।
*
একবার পাড়ায় বেড়াতে এসেছেন নতুন এক জামাই। কবি নজরুল তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে ফন্দি করলেন একটা। এর কাছ থেকে টাকা খসাতে হবে কৌশলে। জামাইকে গিয়ে তিনি বললেন,
নতুন জামাইকে দরমা পীরের দরগায় যেতে হয়। চলুন,চলুন। নাহলে অকল্যাণ হবে।
আগে থেকেই লাল কাপড়ে ঢেকে রাখা হয়েছিল একটি ‘দরমা ঘর’। সেটি এক পোড়োবাড়িতে অবস্থিত। নতুন জামাই গেলেন সেখানে। দরগায় সালাম করলেন। সেলামিও দিলেন। সেই ‘দরমা’ হলো হাঁস-মুরগির খোঁয়াড়। এবার সদলবলে তারা গিয়ে হাজির হলেন জামাইয়ের শ্বশুরবাড়িতে। গেটে দাঁড়িয়ে ছড়া কাটতে শুরু করলেন নজরুল,
মাসি গো মাসি
তোমার জামাইয়ের দেখ হাসি
দরমা পীরে সালাম দেওয়ালাম
খাওয়াও মোদের খাসি।
*
স্বভাবরসিক নজরুল অনেক কিছুর নিজস্ব নামকরণ করতেন। এ্যারিস্ট্রোক্র্যাট শব্দের তিনি বাংলা করেছিলেন ‘আড়ষ্টকাক’। যারা বক্তৃতাবিলাসী অর্থাৎ বক্তৃতা দিতে খুব ভালোবাসেন, তাদের বলতেন ‘বখতিয়ার খিলজী’। কোনো কথার যদি মোড় ঘুরিয়ে দিতে চাইতেন, বলতেন ‘জানে দেও কন্ডাক্টর’। fun এবং পান দুটোই ছিল তাঁর ভীষণ, ভীষণ প্রিয়। একটি বিখ্যাত পানপাত্র ছিল কবির। যেটাকে তিনি নাম দিয়েছিলেন ‘পানের সিন্দুক’। এক শ’ পান নাকি থাকতো এই পানের পাত্রে। বাপ রে বাপ!
লিখতে লিখতে মাঝে মধ্যেই মুখে পুরতেন তিন চারটা পান,আর পিকদানিতে ফেলতেন পিক।
এই পান নিয়ে মজার মজার ঘটনা আছে। এক ভদ্রমহিলা একবার একটা মন্তব্য করে ফেঁসে গিয়েছিলেন। নজরুলের অত্যধিক পান খাওয়া দেখে তিনি জিগ্যেস করলেন,
আচ্ছা আপনি কী পানাসক্ত?
নজরুল চটপট উত্তর দেন এ প্রশ্নের। বলেন,
জি না। আমি বেশ্যাসক্ত।
শুনে ভদ্রহিলা বেশ বিব্রত। দেখে নজরুল তাঁর কথার ব্যাখ্যা দিলেন। বললেন,
পান একটু বেশি খাই। তাই বেশ্যাসক্ত। অর্থাৎ বেশি যোগ আসক্ত ইকোয়াল টু বেশ্যাসক্ত।
*
যমুনা গাঙের পারে সিরাজগঞ্জ। সেখানে বেড়াতে এসেছেন নজরুল। আসাদউদ্দৌলা সিরাজীর ঘরে কবিকে খেতে দেওয়া হয়েছে। সবার পাতে দেওয়া হয়েছে ইলিশ মাছের ভাজি। কবির পাতেও একখানা আছে। কবি তা খেয়ে মাত্র শেষ করতে যাচ্ছেন, এ সময় একজন তার প্লেটে আরো ইলিশভাজা দিতে গেলেন। রসিকপ্রবর কবি বাধা দিলেন তাকে। বলে উঠলেন,
আরে আরে, করছো কী? শেষকালে আমাকে বিড়ালে কামড়াবে তো।
উপস্থিত সবাই এ কথার মরতবা বুঝতে পারলো না। পারার কথাও না অবশ্য। একজন জিগ্যেসই করে ফেললেন,
এর মানে?
নজরুল বললেন, আরে বুঝলেন না! ইলিশ মাছের গন্ধ মুখে লালা ঝরাবে। বিড়াল মাতাল হয়ে যায় এর ঘ্রাণে। বেশি খেলে কী আর রক্ষে আছে? সারা দেহ থেকে গন্ধ ছুটবে, আর সে গন্ধ পেয়ে বিড়াল তেড়ে আসবে।
এই ব্যাখ্যা শুনে সবাই হেসে ফেললেন।
খাওয়া দাওয়ার পর্ব প্রায় শেষ।
কবির পাতে দই দেওয়া হচ্ছে। দই একটু মুখে দিলেন কবি। অদ্ভুত ভঙ্গিতে বিস্মিত কণ্ঠে আসাদউদ্দৌলাকে শুধালেন,
কী হে! তুমি কী এ দই তেঁতুল গাছ থেকে পেড়ে নিয়ে এলে নাকি!
*
শৈলেন নামে কবির এক বন্ধু ছিলেন। এই বন্ধুর কাছ থেকে চা খেতেন বারবার। প্রতিদিন শৈলেনের কাছ থেকে চা খাওয়া চাই। এর জন্য নিত্যনতুন ফন্দিফিকির করতে হতো নজরুলকে।
একদিন কোনো কৌশল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। শৈলেনের কাছে গিয়ে বললেন কবি,
তুমি তো অনেক টাকা পাবে আমার কাছে। হিসাব করে রেখো। আপাতত দু’পেয়ালা চা দাও।
শুনে শৈলেন অবাক! এটা আবার কেমন কথা! অনেক টাকা পাওনা থাকার সঙ্গে দুই পেয়ালা চায়ের সম্পর্কটা কী? ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। তিনি নজরুলকে বললেন,
দু’পেয়ালা কেন?
এ প্রশ্নে যে উত্তর দিলেন কবি, তা হলোঃ
আরে লাখ পেয়ালা চা না খেলে টাকা হয় না। লাখ পেয়ালা হতে আমার এখনো দু’পেয়ালা বাকি আছে!