Published : 29 May 2025, 12:18 AM
দ্বিজেন শর্মা [২৯ মে ১৯২৯-১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭]-র জন্ম মৌলভিবাজার জেলাধীন বড়লেখা উপজেলার শিমুলিয়া গ্রামে। বলা নিষ্প্রয়োজন যে, সেকালে শিমুলিয়া গ্রাম ও পারিপার্শ্বিক এলাকায় ছিল বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ, লতাগুল্মে সজ্জিত পরিবেশ। এ-পরিবেশ মানুষের তৈরি নয়, যা ছিল প্রকৃতির অসামান্য নির্মাণ। তিনি অনেকবারই শিমুলিয়া গ্রাম ও সংলগ্ন পাথারিয়া পাহাড়, মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত এবং হাকালুকি হাওরের সৌন্দর্য বিষয়ে বলেছেন। যে-পরিবেশে তিনি অতিবাহিত করেছেন তাঁর বাল্য-কৈশোর কাল। লেখাপড়া, কর্মসূত্রে অবস্থান পরিবর্তিত হলেও দ্বিজেন শর্মার মননে ছিল সেই জঙ্গল, ফুল, পাখি, প্রাণি সমৃদ্ধ পাহাড়, নিসর্গে আবৃত গ্রাম ও হাওর। ফলত লেখাপড়ার ব্যাপ্তি, সাংস্কৃতিক চেতনা, দেশ বিদেশের অভিজ্ঞতায়, পূর্ণতায় অভিনন্দিত দ্বিজেন শর্মা। যে নিসর্গের কোলে জন্ম ও বড় হয়ে ওঠা, এ-সংশ্লিষ্ট তাঁর বিবরণ আমাদেরও আপ্লুত করে। এ কারণে যে, ওই প্রকৃতির মায়া এখন আর নেই। আগ্রাসী ইট-রড-সিমেন্টের দাপট মুছে দিয়েছে সকল চিহ্ন, এবং উচ্ছেদও করেছে। তিনি স্মরণ করেছেন, ‘আমাদের বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে উত্তরে তাকালে দেখা যায় নিকড়ি নদী, মৌলবি সাহেবের মাজার, ধানখেত, দূরদিগন্তে খাসিয়া পাহাড়ের নীলাভ ঢেউ। মাজারের কাছেই ছিল কয়েকটি জারুলগাছ। প্রতি গ্রীষ্মে গাছগুলো বেগুনি রঙের ফুলে আচ্ছন্ন হতো, রঙিন মিনারের মতো দাঁড়িয়ে থাকা ওই গাছগুলোর ঝরে পড়া ফুলে কবরভূমি ঢেকে যেত। জন্মভূমির এই অনুপম দৃশ্যপট আজও মনে পড়ে’।[শর্মা ২০১৩(১) : ২৯৩]
পরবর্তীতে যেখানেই গিয়েছেন, তাঁর মনে খেলা করেছে সেই বনবনানী, পাহাড় ও হাওর। একইসাথে তাঁর কিশোর বয়সে দেখা প্রাকৃত, নিসর্গপণ্ডিত শোভাবুড়োর জীবন যাপন। যিনি তাঁকে প্রথম জীববৈচিত্র্যের পাঠ শিখিয়েছেন। পাথারিয়া পাহাড়ের বিচিত্র বৃক্ষ, লতাগুল্মের পরিচিতিসহ শিকার পদ্ধতির জ্ঞান দিয়েছেন। কয়েকটি লেখায়ও তিনি শোভাবুড়োর স্মৃতি উল্লেখ করেছেন। কারণ শোভাবুড়োর জন্ম, বেড়ে ওঠা ও জীবনের আদ্যন্ত ছিল এ-প্রকৃতির মধ্যে। ফলে জীববৈচিত্র্য, বৃক্ষ, লতাগুল্মের ধারণা ছিল সরল, প্রাকৃত। দ্বিজেন শর্মা শোভাবুড়োর স্মরণে একটি বার্তা দিয়েছেন আমাদের। অর্থাৎ প্রকৃতির কাছ থেকে আমরা যে জ্ঞান অর্জন করি, তা মুদ্রিত অক্ষরের বিবরণের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও টেকসই। আবার দীর্ঘদিন পর যখন তিনি জন্মমাটিতে গিয়েছেন, তখন সেই পথঘাট, পরিবেশ তাঁর কাছে মনে হয়েছে একেবারেই অচেনা। কারণ বিশ্বায়নের প্রভাব ও বাণিজ্যকেন্দ্রিক বিবেচনায় সমূলে উচ্ছেদ করা হয়েছে তাঁর দেখা প্রকৃতি ও সংশ্লিষ্ট পরিবেশ। তখন হাহাকার, বিলাপ ছাড়া আর কিছু করার অবশেষ ছিল না। তাঁর কথায় তখন শুধুই স্মৃতিকাতরতা, ‘‘তারপর প্রায় পঞ্চাশ বছর কেটে গেছে। পাহাড়ের এই এলাকাটা এখন আবাদ। চারদিকে লোকবসতি। সাপখোপ, জন্তুজানোয়ার, পাখপাখালি সবই লাপাত্তা। ... সামনে এসে দাঁড়ায় প্রকৃতির শোভাবুড়ো, মাথায় মস্ত টাক, গায়ে ফতুয়া, পরনে হাফপ্যান্ট যার কাছ থেকে প্রকৃতিকে ভালোবাসতে শিখেছিলাম, প্রকৃতিকে জানতে শিখেছিলাম, কেননা ভালো না বাসলে তো কাউকেই জানা যায় না, আর সেই জানাটুকু আজো আমার জীবনের একটা অবলম্বন হয়ে আছে, সংসারের নড়বড়ে ভিতে আমাদের দিব্যি দাঁড় করিয়ে রেখেছে এবং এ কথা বলার সাহস যোগাচ্ছে যে ‘এ দ্যুলোক মধুময়, মধুময় পৃথিবীর ধূলি।’’ [শর্মা ২০১৫(৩) : ১৮১-১৮২]
উল্লেখযোগ্য, যে নিসর্গ ভাবনায় তিনি নিজেকে প্রস্তুত করেছেন, তা তিনি লালন করেছেন আজীবন। পেশাগত জীবনের শুরুতেই ঢাকা শহরের পথতরুর পরিচিত চিহ্নিতকরণ, বিবরণ লেখা ইত্যাদি কাজ করেছেন সেই ১৯৬৪ সালে। এ-পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত ও বাংলা একাডেমিতে জমা দেন ১৯৬৫ সালে। তবে ‘শ্যামলী নিসর্গ’ শিরোনামের বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৮০ সালে। এমন একটি অসামান্য গ্রন্থের পর ঢাকা মহানগরের বৃক্ষ পরিচিত নিয়ে আর কোনও বই আমাদের চোখে পড়েনি। বস্তুত তাঁর ইকোলজি বা ইকোক্রিটিসিজম ভাবনা যে বৈশ্বিক, তা মূল্যায়নের জন্য আন্তর্জাতিক পরিসরের তত্ত্ব না নিলেও চলে। যেমন প্রকৃতিসমগ্র ১- এ তিনি বলেছেন, ‘প্রকৃতি আমাদের স্রষ্টা ও বিনষ্টাও। আমরা প্রকৃতিকে ভালোবাসি, আবার একইসঙ্গে তার সঙ্গে লড়াইও করি। স্মর্তব্য প্রকৃতি তার সৃষ্টি ও ধ্বংসের স্বভাবধর্ম মানবসত্তায় সঞ্চারিত করেছে যা সামাল দিতে সে অক্ষম, কেননা মানুষ প্রকৃতির মতো অমিত শক্তিধর নয়। ফলত প্রকৃতির উপর তার জয়লাভের উচ্চাশা আজ হতাশায় পর্যবসিত এবং সে নিজেও বিপন্ন। এ থেকে উদ্ধারের প্রধান সম্বল তার প্রজ্ঞার পুঁজি, কিন্তু এখানে প্রধান প্রতিবন্ধ হয়ে আছে প্রলোভন। এটাও আরেকটি দ্বন্দ্ব’। [শর্মা ২০১৩(১) : ৯] তাঁর এ ভাবনা অন্য সকল আন্তর্জাতিক ভাবনার মতো অগ্রবর্তী। প্রসঙ্গত র্যাচেল কারসন রচিত Silent Spring (১৯৬২)-এ বিবৃত ইকোলজির নতুন চিন্তা ব্যতীত দ্বিজেন শর্মার আগে কেউ এমন ভেবেছেন বলে আমাদের জানা নেই। সম্প্রতি ইকোলজি-ভাবনা যে অগ্রসর ও বিস্তৃত হয়েছে তা বলাই বাহুল্য। তবে দ্বিজেন শর্মারও এ ধরনের প্রাসগর চিন্তা ছিল, তা আমাদের খেয়াল রাখতে হয়। তুল্য বিবেচনার জন্য সংক্ষেপে একটি বক্তব্য এখানে উল্লেখ করা যায়। যেমন, Ecocriticism is unique amongst contemporary literary and cultural theories because of its close relationship with the science of ecology. Ecocritics may not be qualified to contribute to debates about problems in ecology, but they must nevertheless transgress disciplinary boundaries and develop their own ‘ecological literacy’ as far as possible. I therefore provide brief discussions of some important environmental threats faced by the world today…but it is essential for ecocritics to recognize that there are serious arguments about the existence of the problems, their extent, the nature of the threat and the possible solutions to them. [Garrard 2004: 5]
এ কথার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ইকোক্রিটিসিজম প্রকৃতি ও সাহিত্যের মধ্যে শুধু সীমাবদ্ধ নেই। বিজ্ঞান তো অবশ্যই। এ ছাড়াও আলোচনা প্রসারিত হয়ে আছে সমাজ, রাজনীতি, দর্শন, নৃতত্ত্ব, সংস্কৃতি, শিল্প-কারখানা, উৎপাদন, স্থাপত্যসহ সকল জ্ঞানবিদ্যা এবং ভৌত জীবনাচরণে। অতএব পশ্চিমের কাঠামোবদ্ধ আলোচনার আগেই প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্য থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে দ্বিজেন শর্মা প্রমুখ জীবন, শিল্প এবং পরিবেশের বোঝাপড়া আত্মস্থ করেছেন। প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। এ ছাড়াও প্রাচ্য মিথ-পুরাণ-দর্শনে প্রকৃতি চেতনার সমূহ উদাহরণ লক্ষণীয়। এসব উদাহরণ, বক্তব্য, প্রবাদ-প্রবচন, থাকাই স্বাভাবিক। কারণ প্রাচ্যে প্রকৃতি ও জীবন পরস্পর, একাকার। যেক্ষেত্রে প্রাণের আধার এবং জীবন যাপন নির্ভরশীল এ-পরিবেশের ওপর।
এ-মানবসমাজ, প্রাণিজগৎ, প্রকৃতি ইকোলজিরই অংশ। মানবসমাজ প্রাণিসমবায় বেঁচে আছে এ-পরিবেশে জ্ঞাত- অজ্ঞাত লেনদেনের মাধ্যমে। একটি বিপর্যস্ত হলে আরেকটি বাঁচে না; অর্থাৎ একটি আবর্ত শৃংখল বিদ্যমান। এ জন্য দ্বিজেন শর্মা শুধু প্রকৃতি, নিসর্গ নিয়ে কথা বলেননি, বলেছেন ইকোলজি প্রসঙ্গে। কারণ ‘পরিবেশ ব্যাতিরেকে কোনো জীব বাঁচতে পারে না। প্রতিটি জীবের সঙ্গে পরিবেশের অন্যান্য জীব এবং জড় উপাদানের অবিরাম মিথষ্ক্রিয়া ঘটে। জীবগোষ্ঠীর পারস্পরিক এবং পরিপার্শ্বের সঙ্গে জীবগোষ্ঠীর সম্পর্ক অধ্যয়নই হলো বাস্তুসংস্থান বা Ecology’। [পাল ২০১০ : ৩৫] সুতরাং এককভাবে বিচার ও সমাধান কল্পনা করা হলেও পরিবেশের সুরক্ষা সম্ভব নয়। এসব বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছেন আজীবন দ্বিজেন শর্মা। ফলে তিনি নিসর্গ ও পরিবেশ চর্চায় নিজেকে একাডেমিক পরিসরের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি। যে কারণে আমরা তাঁকে স্মরণে রাখার চেষ্টা করি।
বস্তুত সভ্যতা, উন্নয়ন ও দখলের আগ্রাসনে প্রকৃতির বিনাশ অনেক আগে থেকেই শুরু। একইসাথে মানুষের আদর্শ, বিশ্বাস, আচার পালনের প্রতিক্রিয়ায় এ নিসর্গ বিপন্নপ্রায়। এসব বিষয়ে এমনও পক্ষ আছে, যারা বলার চেষ্টা করে যে, প্রকৃতির ওপর মানুষের আধিপত্য ছাড়া কোনও সম্পর্ক নেই। মানবসমাজ নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশে, লোভ-লালসা, আধিপত্যের বাসনায় প্রকৃতি ধ্বংসের কাজ চালাচ্ছে আদি কাল থেকে। ন্যূনতম প্রয়োজনে শুধু সংহার আর সংহার। আরও একটি বিষয় লক্ষণীয়, নিসর্গের সৌন্দর্যও শত্রুসম উপাদান হিসেবে কেউ কেউ গণ্য করে। যেখানে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, বিশ্বাস, চর্চাও ক্রিয়াশীল। এই সৌন্দর্যচর্চার বিরোধিতার প্রসঙ্গ আমরা সাধারণত আমলে নিতে চাই না। অতএব মানুষ বনাম প্রকৃতি-পরিবেশ প্রায় বিপরীত অবস্থানে মুখোমুখি। এ সংকটাবস্থায় পরিবেশ সংরক্ষণে অনেকেই এগিয়ে এসেছেন; তবে কোনও উপায় বের হচ্ছে না। এ সমস্যাটি এখন আর স্থানিক নয়; যখন বৈশ্বিক দূষণের প্রেক্ষিতে যা বিবেচনা করা হচ্ছে। একটি অঞ্চল বা বাংলাদেশে যখন ঝড়, বজ্রপাত, বন্যা, খরা, ভাঙন, ধস হতে থাকে। আমরা জেনেছি এসব শুধুই আঞ্চলিক কারণে ঘটছে না। যে সব বৈশ্বিক পরিবেশ বিপর্যয়েরই ফল। মূলত ‘মানবসভ্যতার ইতিহাস দূষণেরও ইতিহাস। যে কোনো প্রাণী তার পরিবেশের অন্যান্য প্রাণী ও বস্তুজগতের সঙ্গে একটি মিথষ্ক্রিয়ার সম্পর্কে বেঁচে থাকে, একে বলে ইকোসিস্টেম (Eco-system)’ [রায় ২০১৫ : ২৯৩] ফলে নিসর্গ সংরক্ষণে মিথোজীবীতার কথাই বলেছেন দ্বিজেন শর্মা। Ralph Waldo Emerson যেমন বলেছেন the happiest man is he who learns from nature the lesson of worship’
বলা নিষ্প্রয়োজন যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিষয়ে আমরা কিছু করতে পারি না। তবে এ দুর্যোগের প্রতিকার সম্ভব; এবং কমিয়ে আনা যায়। মানুষ দ্বারা তৈরিকৃত দুর্যোগের অংশত পরিণাম হলো প্রাকৃতিক দুর্যোগ। অর্থাৎ আমাদের স্বভাব প্রাকৃতিক দুর্যোগের উৎস। বস্তুত পরিবেশের সাথে যেখানে সংযোগ, সেখানে দূষণ ও ধ্বংসে জড়িত রয়েছি আমরা। সম্প্রতি বিশ্বায়ন আকৃষ্ট প্রলোভন আমাদের প্রণোদিত করছে পরিবেশ দূষণে। আবার অস্বীকার করতে পারি না যে, উপনিবেশ ও উপনিবেশায়নের ক্রিয়াকর্ম এখনও চলমান। আমরা জানি না, বিশ্বায়নের নামে ধ্বংসের থাবা কখন, কীভাবে থামানো যাবে। শিল্পায়নে অগ্রসর সমৃদ্ধ দেশসমূহ উপনিবেশায়নের নেতৃত্বে ছিল এবং আছে। এর আগে অপেক্ষাকৃত অনগ্রসর অথচ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ দেশগুলোতে তারা উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। যে ঔপনিবেশিক শাসন দীর্ঘায়িত করতে উন্নয়নের বয়ানও ছিল। এটা হলো সম্পদ লুণ্ঠনের প্রক্রিয়া মাত্র। এর পর বিশ্বায়নের ধাপে ধাপে নতুন নুতন দৃষ্টিভঙ্গি, লোভনীয় নিমন্ত্রণ, নগরায়নের বিলাসী কর্মসূচি এ সমাজকে অস্থির করে তুলেছে। ফলে প্রকৃতি ধ্বংসের জন্য যেমন ঔপনিবেশিক স্বপ্নজাল রয়েছে, তেমনি রয়েছে আমাদের অজ্ঞানতা ও অবহেলা। সংগত কারণে যান্ত্রিক উন্নয়নের প্রসঙ্গ চলে আসে। দ্বিজেন শর্মাও বলেছেন, আজকের প্রেক্ষিতে বিশ্বায়ন, যন্ত্র ও প্রাযুক্তিক উন্নয়ন এড়ানো যাবে না। এ জন্য এসব উন্নয়ন কর্মসূচির সাথে সংগতি রেখে নিসর্গ রক্ষায় মনোযোগী হওয়া জরুরি। তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন, জীবনের জন্য তিনটি সুখের কথা-- রৌদ্র, ব্যাপ্তিস্থান ও শ্যামলিমা। কিন্তু এ-তিনটির মধ্যে আর অবশেষ কতটুকু রয়েছে। এর বিপরীতে তাঁর দুঃশ্চিন্তার কারণ হয়েছে বিশ্বায়নের চাপ। ফলত তিনি অনেক আগেই চিন্তা করেছেন পরবর্তী দিনগুলোর অবস্থা ও দহন প্রসঙ্গ। তাঁর ভাবনা হলো, যদি ঢাকা মহানগরের সকল ত্রুটি নিয়ে অন্য শহরগুলো এগুতে থাকে। তা হলে মফসসলের শহর নির্মাণও হবে ত্রুটিপূর্ণ। এর প্রভাবে গ্রামীণ কৃষিজীবনের দ্রুত রূপান্তর ঘটেছে। মূলত অপরিকল্পিত নগরনির্মাণ, উন্নয়নকর্ম নিশ্চিত বিপদে ফেলতে বাধ্য। তবে এর মাঝেও তিনি আস্থা রেখেছেন সমাজের অন্তর্নিহিত পুনর্গঠন শক্তির ওপর। এ অবস্থায় মানবসমাজের পরিণতি, পরিণাম, প্রতিকার বিষয়ে তিনি বলেছেন, ‘মানুষ আজ প্রকৃতির একটি বিকল্প শক্তি হয়ে উঠেছে। ... আপন নিরাপত্তা ও সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য মানুষ প্রকৃতির রাজ্যকে ঢেলে সাজাতে চাইছে, তাতে ভেঙে পড়ছে গোটা গ্রহের বাস্তুসংস্থান এবং তারই ফল হলো বিশ্ব উষ্ণায়ন, বায়ু ও পানিদূষণ, চির তুষারগলন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও ওজোনস্তর ক্ষয়, বৃষ্টিপাতের প্যাটার্ন পরিবর্তন, জীববৈচিত্র্য হ্রাস ইত্যাকার নানা বিপর্যয়ী আলামত। বনায়ন অবশ্যই প্রয়োজন, কিন্তু এককভাবে তাতে কোনো সমাধান নিহিত নেই’। [শর্মা ২০১৩(২) : ৩০৪]
সম্প্রতি বিশ্বে পরিবেশ আন্দোলনের মধ্যে লক্ষ করা যাচ্ছে প্রচুর বিতর্ক। কারণ উন্নয়ন, ভোগবিলাস, বাণিজ্য, কার্বন নিঃসরণের দায় ইত্যাদি নিয়ে বিশ্বে ঝগড়া বিবাদ কম হচ্ছে না। প্রযুক্তির উন্নয়ন ও দ্রুত বিকাশমানতা এ বিতর্ক আরও উসকে দিয়েছে। ফলে আমরা এ বিতর্ক থেকে বের হতে পারবো বলে মনে হয় না। এ ছাড়াও অংশত ঝুঁকিতে ফেলেছে পরিবেশের পক্ষের অথচ অপবিশ্বাসজনিত কথামালা। অন্যদিকে শিল্পায়নের পক্ষে- বিপক্ষে যুক্তি-তর্ক রয়েছে। কিন্তু হাল আমলে শিল্পায়নের গুরুত্বকে আমরা কেউই অস্বীকার করতে পারবো না। আবার শিল্পস্থাপনা বা নেহাত ঘর-গেরস্থালির কাজেও অনেকে নিসর্গ বিন্যাস, প্রকৃতির ভারসাম্য, জীববৈচিত্র্যের ক্ষয়-ক্ষতি খেয়াল করছে না। যেমন চাষাবাদ যেখানে হওয়ার কথা নয়, সেখানে আবাদ করা হচ্ছে। আবার ফসল টিকিয়ে রাখা ও অধিক উৎপাদনের লক্ষে ব্যবহার করা হচ্ছে আমদানিকৃত বীজ, মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক, সার ইত্যাদি। এর পরিণামে মাটি ও জলে কীটনাশক ও সারের উপাদান মিশে যাচ্ছে ক্রমশ। পরিণামে মাটিসহ জল এবং জলজ ইকোসিস্টেম বিপন্ন-প্রায়। এর ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া ঘটছে জীবজগতে। যেমন নদী এবং হাওরের মৎসম্পদ, জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের ওপর এর ক্ষতিকর প্রভাব আমরা লক্ষ করছি। এভাবে প্রকৃতির সংহারে দ্বিজেন শর্মা হয়েছেন ক্ষুব্ধ এবং মনে মনে অনেক কষ্ট অনুভব করতেন। যেক্ষেত্রে তিনি বলেছেন, ‘মানুষ ক্রমাগত অরণ্য আবাদ করে ফসলের খেত বানিয়েছে, বনের পশুপাখি, কীটপতঙ্গের কথা এতটুকুও বিবেচনা করেনি, তাদের মুখের গ্রাস নিদ্বির্ধায় কেড়ে নিয়েছে। মানুষের সৃষ্ট ফসলে অনভ্যস্ত পশুপাখি, কীটপতঙ্গ প্রথমে পিছু হটলেও শেষে এতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে ও আরও জোরেশোরে হামলা চালিয়েছে। সমস্যা মোকাবিলায় উদ্ভাবিত হয়েছে কীটঘ্ন। গোড়ার দিকে চমৎকার ফল ফলালেও কুফল ধরা পড়তে দেরি হয়নি।... কীটঘ্ন ব্যবহারে কীটপতঙ্গের ক্ষয়ের ফলে এগুলোর ওপর নির্ভরশীল পাখির সংখ্যা যথেষ্ট কমে গেছে। কিন্তু কীটেরা কীটঘ্ন পদার্থে ক্রমে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে আবার যখন ফসলের ওপর ব্যাপক হামলা চালায়, তখন পতঙ্গভুক পাখিদের আর দেখা যায় না। এই হলো গোটা ব্যবস্থার অন্তর্লীন অসংগতি’। [শর্মা ২০১৩(২) : ১৫৫-১৫৬]
তিনি বিভিন্ন লেখা ও বক্তব্যে নির্বিচার বাস্তু ধ্বংসকরণ প্রক্রিয়া উল্লেখ করেছেন। তাঁর প্রশ্ন হলো, এসব কেন, কীভাবে হচ্ছে। শুধু এ দেশে নয়, বিশ্বের নানা জায়গায় সে উন্মত্ততা লক্ষণীয়। সাধারণ আবাসিক গৃহসহ ইমারত, রাস্তা, শিল্পস্থাপনা নির্মাণে নষ্ট করা হচ্ছে মাটির বৈশিষ্ট্য ও ভারসাম্য। যেভাবে চলছে বিভিন্ন জাতের বৃক্ষরাজি উজাড়করণ নিত্য ঘটনা। ট্রপিক্যাল বনজঙ্গল ধ্বংস করে ইকোপার্কের নামে কৃত্রিম বিনোদন পার্ক ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা হচ্ছে। ফলে পাখিসহ নানা রকম প্রাণী এখন দৃশ্যমান নয়। এক কথায় মানুষের অসহায়ত্ব বেড়েই চলেছে, মানুষের আচরণে। পরিবেশ আন্দোলনের নামে, বনায়নের নামে যা করা হয়, তিনি তার বিপক্ষে ছিলেন সকল সময়। তাঁর কথায় শুধু গাছ লাগিয়ে উষ্ণায়ন কমানো যাবে না। কারণ আমরা এখন প্রকৃতির প্রতিশোধের সম্মুখীন। তিনি এ বিষয়ে এঙ্গেলসের একটি কথা উল্লেখ করেছেন। ‘প্রকৃতির উপর মানুষের বিজয়লাভ নিয়ে অত্যাশা বাঞ্ছনীয় নয়। এই ধরনের প্রতিটি বিজয়ের পর প্রকৃতি প্রতিশোধ নেয়। এসব বিজয় শুরুতে ইপ্সিত ফল ফলালেও শেষে নানা বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। তাতে প্রায়শই প্রথমটি ঢাকা পড়ে যায়’। [উদ্ধৃত, শর্মা ২০১৩(২) : ৩০৫]
তাঁর পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত পরিষ্কার। মানুষ সজ্ঞানে, অজ্ঞানে প্রকৃতির শৃংখল ভেঙে ফেলেছে। ফলে এ জীববৈচিত্র্য থেকে অনেক উদ্ভিদ ও প্রাণি হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। ফলে এ বৈচিত্র্যের শৃংখল সংকুচিত হতে চলেছে। মূলত কোন্ প্রজাতি কখন মানবজাতির উপকারে আসতে পারে, তা কেউ জানে না। এ জন্য বিশ্বের অনেক দেশে বীজব্যাংক তৈরি হয়েছে। কারণ অনেক প্রজাতির প্রাণি ও উদ্ভিদ বিপন্ন-প্রায়। ফলত এসব প্রজাতি যাতে একেবারে হারিয়ে না যায় এ জন্য বীজভাণ্ডারের উদ্যোগ রয়েছে নানা দেশে। দ্বিজেন শর্মার কথা, আলোচনা থেকে জেনেছি, তিনি দেশের নানা স্থানে উদ্যান ও বাগান তৈরি করতে চেয়েছেন, তবে পারেননি। এত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও যেখানে সুযোগ পেয়েছেন, সেখানে পরিসর যত ছোটোই হোক, তা বাস্তবায়নে তৎপর থেকেছেন। এর প্রমাণ রয়েছে শিমুলিয়া, বিএম কলেজ, বরিশাল ও ঢাকায়। তিনি অরণ্য, গ্রাম, রাজপথ, শহর, মহানগর, নগরপথসহ বিভিন্ন স্থানকে বিন্যস্ত করতে চেয়েছেন বৃক্ষ ও লতাগুল্মে। এরূপ বিন্যাসে কিছু কাজও করেছেন। তাঁর কথা-- ‘উদ্যানশিল্প যে স্থাপত্যের অনুষঙ্গ এবং তদনুরূপ গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল এই বোধ এখনো আমাদের দেশে স্বীকৃতি পায়নি, নইলে আমাদের পার্কগুলোতে এমন নৈরাজ্য বা অবহেলা প্রশ্রয় পেত না’। [শর্মা ২০১৩(২) : ১৩৭]
তাঁর মতো আমাদেরও জিজ্ঞাসা, ‘মানুষ কী চায়-- উন্নতি, না আনন্দ? উন্নতি করিয়া কী হইবে যদি আনন্দ না থাকে?’ আমরা কেন সৌন্দর্য সম্পর্কে এত উদাসীন; যথেষ্ট উদ্যান বাগান কেন তৈরি করতে পারি না; আবার শিল্প, ভাস্কর্য, সংগীত নিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কার নয় কেন। এমন নানা প্রশ্নের তিনি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বাগান নির্মাণ যে শিল্পকর্ম, তা আমরা জানি না। শিল্পকর্ম, উদ্যান যাই বলি না কেন, এসব নিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি স্বচ্ছ নয়। ফলে দ্বিজেন শর্মা লক্ষ করেছেন, মানুষের প্রাত্যহিক জীবনাচরণে কৃত্রিম বস্তুসমগ্রের ছড়াছড়ি। আমরা শিক্ষা গ্রহণের পরই চিরচেনা গ্রাম, কৃষি সংশ্লিষ্ট জীবন ও সংস্কৃতি ভুলে যাই। এর ফলে কৃষি সংস্কৃতি থেকে শুধু বিচ্ছিন্ন হই না; এ বিচ্ছেদ প্রশস্ত হতে থাকে বিভিন্ন পথে। অথচ এদেশ ‘নিসর্গ-সম্পদে-বৈচিত্র্যে-বিস্ময়ে পরিপূর্ণ’। বস্তুত নিসর্গ ঋদ্ধ দেশ বিচ্ছেদে না থেকে নিসর্গেরই মাধ্যমে মিলনে পূর্ণ হবে-- এই কামনা করেছেন প্রকৃতিপুত্র দ্বিজেন শর্মা।
তথ্যসূত্র
পাল, গৌতম।(২০১০)। পরিবেশ ও দূষণ। কলকাতা : দাশগুপ্ত অ্যান্ড কোম্পানি
রায় মোহিত [সম্পাদনা]।(২০১৫)। পরিবেশচর্চা : ইতিহাস ও বিবর্তন। কলকাতা : অনুষ্টুপ
শর্মা, দ্বিজেন। (২০১৩)। প্রকৃতিসমগ্র ১। ঢাকা : অনিন্দ্য প্রকাশ
….। (২০১৩)। প্রকৃতিসমগ্র ২। ঢাকা : অনিন্দ্য প্রকাশ
…..। (২০১৫)। প্রকৃতিসমগ্র ৩। ঢাকা : অনিন্দ্য প্রকাশ
Garrard, Greg. (2004). ECOCRITICISM : Routledge